বাংলো থেকে কে বেরোলি? মিস্টার রক্ষিত। এক হাতে লাঠি, অন্য হাতে টর্চ, গায়ে ঢাউস রেনকোট। ভদ্রলোক লালমোহনবাবুর কানের কাছে এসে তারস্বরে আফটার ডিনার ওয়াক এ মাইল।–বলে হেসে গেস্ট হাউসের দিকে চলে গেলেন।
শুভঙ্কর বোসও গুড নাইট বলে রক্ষিতের পথ ধরলেন। লালমোহনবাবু ভুকুটি করে বললেন, এক মাইল হাঁটতে বললে কেন বলে তো লোকটা?
আমি বললাম, ভাল হজম হবে বলে। …চলুন, এখন তো বাংলো খালি, একবার ফেলুদার খোঁজ করা যাক। ওকে খবরগুলো দেওয়া দরকার। এরা সবাই গুহার দিকে যাচ্ছে। ব্যাপারটা ভাল লাগছে না।
একটা চাপা উত্তেজনা নিয়ে বাংলোয় ঢুকলাম। মিস্টার বোস সত্যি বললেন কি মিথ্যে বললেন জানি না, কিন্তু আমার মন বলছে একবার গুহার দিকে যাওয়া উচিত; যদি কিছু ঘটে তা হলে রাত্রেই ঘটবে। এখনও আলো রয়েছে, গুহার আশেপাশে কেউ ঘোরাফেরা করলে নিশ্চয়ই বোঝা যাবে।
বাংলোর ভিতরে অন্ধকার। বাইরের চৌকিদারের ঘরে বোধহয় একটা লণ্ঠন জ্বলছে। আর কোথাও আলো নেই। কোনও শব্দও নেই।
রক্ষিতের ঘরের দরজা বন্ধ থাকবে সেটা স্বাভাবিক, কিন্তু ফেলুদার দরজাও বন্ধ কেন? আর দরজার তলার ফাঁক দিয়ে আলো দেখা যাচ্ছে না কেন? ও কি এই সাড়ে দশটার মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ল নাকি?
বারান্দার দিকে ঘরের জানালা। পা টিপে টিপে গেলাম সেদিকে। জানালার পদার্গ টানা। এগিয়ে গিয়ে পদাৰ্ণ ফাঁক করে দুবার চাপা গলায় ফেলুদার নাম ধরে ডাকলাম। কোনও উত্তর নেই। ও যদি বেরিয়েও থাকে, সামনের দরজা দিয়ে বেরোয়নি সেটা আমরা জানি। তা হলে কি চৌকিদারের ঘরের পাশে খিড়কি দরজাটা দিয়ে বোরোল?
আমরা দুজন আমাদের ঘরে ফিরে এলাম। বাতিটা জ্বালাতেই জানালার সামনে মেঝেতে পড়ে থাকা কাগজটা দেখতে পেলাম। তাতে ফেলুদার হাতে লেখা দুটো কথা–
ঘরে থাকিস।
একটা কথা বলব তোমায়? লালমোহনবাবু বললেন।এবার কিন্তু তোমার দাদটিই আমাদের সবচেয়ে বেশি ভাবাচ্ছেন। আমি তো এমনিতে আর বিশেষ কোনও রহস্য খুঁজে পাচ্ছি না, তবে তোমার দাদার কার্যকলাপ পদে পদে রহস্যময় বলে মনে হচ্ছে।
ফেলুদা ঘরে থাকতে বলেছে, কিন্তু কখন ফিরবে সেটা বলে যায়নি। অথচ ও যতক্ষণ না ফেরে। ততক্ষণ ঘুমোনোর কোনও কথাই ওঠে না; কী আর করি-আধা ঘণ্টা কোনওরকমে লালমোহনবাবুর সঙ্গে কাটাকুটি খেলে কাটিয়ে দিলাম। তারপর লালমোহনবাবু বললেন যে ওঁর লেটেস্ট গল্পের প্লটটা আমায় বলবেন। —এবার একটা নতুন রকমের ফাইট ইন্ট্রোডিউস। করিচি যাতে হিরোর হাত-পা বাঁধা রয়েছে।–কিন্তু তাও শুধু মাথা দিয়ে ভিলেনকে ঘায়েল করে দিচ্ছে।
মাথা দিয়ে মানে বুদ্ধি দিয়ে না মাথার গুঁতো দিয়ে সেটা জিজ্ঞেস করতে যাব এমন সময় দেখি ফেলুদা হাজির। আমরা দুজনেই চুপ, কারণ জানি ও নিজে থেকে কিছু বলতে চাইলেই বলবে, জিজ্ঞেস করে কোনও ফল হবে না।
ফেলুদা গভীর গলায় বলল, লালমোহনবাবু, অন্যান্যবারের মতো এবারও কি আপনার সঙ্গে কোনও অস্ত্ৰ আছে নাকি?
এখানে বলে রাখি লালমোহনবাবুর অস্ত্ৰ সংগ্রহ করার বাতিক আছে। সোনার কেল্লার ব্যাপারে ওঁর সঙ্গে একটা ভুজালি ছিল, আর বাক্স-রহস্যের ব্যাপারে ছিল একটা বুমেরাং। ফেলুদার প্রশ্ন শুনে ভদ্রলোকের চোখ জ্বল জ্বল করে উঠল। বললেন, এবার আছে একটা বম্ব।
বম্ব? আমি আর ফেলুদা একসঙ্গে প্রশ্ন করে উঠলাম। কথাটা বিশ্বাস হচ্ছিল না।
বম্ব টু বোমা।
লালমোহনবাবু তাঁর সুটকেসের দিকে এগিয়ে গেছেন। —আমাদের পাড়ার দ্বিজেন তরফদারের ছেলে উৎপল আর্মিতে আছে। সে মার্চ মাসে এসেছিল। এইটে আমায় এনে দিয়ে বললে-কাকাবাবু দেখুন। আপনার জন্য কী এনিচি! বড় বড় যুদ্ধে ব্যবহার হয়। –ছোঁড়া আমার লেখার খুব ভক্ত।
একটা মাঝারি সাইজের টর্চলাইটের মতো লম্বা খয়েরি রঙের একটা বেশ ভারী পাইপ জাতীয় জিনিস লালমোহনবাবু সুটকেস থেকে বের করে ফেলুদার হাতে দিলেন। ফেলুদা সেটা কিছুক্ষণ নেড়ে-চেড়ে দেখে বলল, এটা আমার কাছেই থাক। আপনার পক্ষে জিনিসটা বড় বেশি ডেঞ্জারাস।
কত মেটাগন হবে বলুন তো?
কথাটা আসলে মেগাটন, আর সেটা ব্যবহার হয় অ্যাটমবোমা সম্পর্কে। এক মেগাটন মানে দশ লক্ষ টন। ফেলুদা লালমোহনবাবুর প্রশ্নে কান না দিয়ে বামাটা ঝোলায় পুরে বলল, একবার বেরোনো দরকার। সবাই বেরিয়েছে, আমাদের ঘরে বসে থাকার কোনও মানে হয় না।
ডাক বাংলো থেকে যখন বেরোলাম তখন সাড়ে এগারোটা। বিক্সিটা এখনও ডাকছে। চাঁদের আলো কমছে-বাড়ছে, কারণ আকাশ টুকরো টুকরো চলন্ত মেঘে ছেয়ে গেছে। গেস্ট হাউসের একটা ঘরে দেখলাম আলো জুলছে। সেটা নাকি সেই আমেরিকগনের ঘর; কে কোন ঘরে থাকে সেটাও নাকি ফেলুদা ম্যানেজারের কাছ থেকে জেনে নিয়েছে। মল্লিক আর শুভঙ্কর ফিরেছে কি না বোঝা গেল না।
কিছুক্ষণ থেকেই ঘন ঘন মেঘ ডাকছিল; যখন বড় রাস্তার উপর এসে পড়েছি তখন একটা বড়ুরকম গর্জন শুনে আকাশের দিকে চেয়ে দেখি পুব দিকটা কালো হয়ে আসছে। এই মরেছে। বৃষ্টি আসবে নাকি? বলে উঠলেন লালমোহনবাবু!
এত গুহা থাকতে বৃষ্টি এলে আশ্রয়ের অভাব হবে না, বলল ফেলুদা।
কৈলাসের দিকে উঠে গিয়ে মন্দিরে ঢোকার কোনও চেষ্টা না করে ফেলুদা বা দিকের পথ ধরল। কিন্তু সে পথেও বেশি দূর না। খানিকটা গিয়েই সে দেখি পথ ছেড়ে পাহাড়ের গা বেয়ে উপরে উঠতে আরম্ভ করেছে। ওর কায়দাকানুন একটু আধটু জানি বলে আন্দাজ করলাম যে সামনের দিক দিয়ে ছাড়া গুহায় ঢ়োকার কোনও রাস্তা আছে কি না সেটাই ও একটু ঘুরে দেখতে চাইছে। আশেপাশে ঝোপঝাড় আর পাথরের টুকরো, কিন্তু এখনও চাঁদের আলো থাকায় সেগুলো কোনও বাধার সৃষ্টি করছে না।