লালমোহনবাবুর কথা থেমে গেল। ফেলুদা প্রায় নিঃশব্দে ঘরে ঢুকেছে।
কার জিনিসের ফিরিস্তি দেওয়া হচ্ছে?
ওকে ব্যাপারটা বলতেই হল। ও কিন্তু শুনে বিশেষ রাগটাগ করল না, খালি বলল, লোকটাকে সন্দেহ করবার কোনও কারণ ঘটেছিল কি?
লালমোহনবাবু আমতা আমতা করে বললেন, কিছুই তো জানা যায়নি। ওর সম্বন্ধে। এমন কী নামটাও না। এদিকে কী রকম ষণ্ডামাক চেহারা.একটা গ্যাঙের কথা বলছিলেন না?–তাই ভাবলুম, মানে…
সন্দেহের কারণ না থাকলে এগুলো করতে যাওয়া অযথা রিস্ক নেওয়া। ভদ্রলোকের নাম আর এন রক্ষিত। সুটকেসের বা ধারে ফ্যাকফেকে সাদা অক্ষরে লেখা, চোখ থাকলেই দেখা যায়। আপাতত এর বেশি জানার কোনও দরকার আছে বলে মনে করি না।
লালমোহনবাবু বললেন, তা হলে বাকি রইল এক সাহেব।
ফেলুদা বলল, সাহেবের নাম স্যাম লুইসন! এও ইহুদি, এও ধনী। নিউ ইয়র্কে এর একটা আর্ট গ্যালারি আছে।
কী করে জানলে? আমি বেশ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম।
গেস্ট হাউসের ম্যানেজারের সঙ্গে আলাপ হল। বেড়ে লোক। ডিটেকটিভ গল্পের পোকা। মূর্তি চুরির কথা কাগজে পড়ে অবধি দিন গুনছে কবে এইখানে সেই চারের আবির্ভাব হবে।
তোমার পরিচয় দিলে?
ফেলুদা মাথা নেড়ে হ্যাঁ জানিয়ে বলল, ওকে হাতে রাখা দরকার। লোকটা অনেক হেলপ করতে পারবে। তুললে চলবে না, মল্লিক গেস্ট হাউসে থাকে। সে নাকি অলরেড়ি বম্বেতে একটা কল বুক করেছিল, লাইন পায়নি।
রাত্রে ডিনার আমরা চারজনে একসঙ্গে বসে খেলাম! ফেলুদা একটাও কথা বলল না! সেটা তার ছদ্মবেশের জন্য, না মাথায় কোনও চিন্তা ঘুরছে বলে, তা জানি না। মিস্টার রক্ষিত একবার লালমোহনবাবুর দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করলেন, ইন্ডিয়ান হিস্ট্রির কোনও বিশেষ পিরিয়ড নিয়ে তিনি চৰ্চা করেন কি না। তার উত্তরে লালমোহনবাবু আড়র ডালে ভেজানো হাতের রুটি চিকোতে চিবোতে বললেন যে পিরামিড নিয়ে তাঁর বিশেষ পড়াশুনো নেই, যদিও সেটা যে মিশরে রয়েছে সেটা তিনি জানেন। এতে রক্ষিত একটু থিতামত খেয়ে আমার দিকে চাইলে আমি নিজের কানের দিকে দেখিয়ে লালমোহনবাবু যে কানে খাটা সেটা বুঝিয়ে দিলাম। এর পরে ভদ্রলোক আর মেজো মামাকে কোনও প্রশ্ন করেননি।
খাওয়ার পরে আমি আর লালমোহনবাবু যখন বাংলোর বাইরে এসে দাঁড়ালাম (ফেলুদা তার ঘরে চলে গিয়েছিল) তখন একটা ঝোড়ো হাওয়া দিচ্ছে, আর টুকরো টুকরো মেঘের ফাঁক দিয়ে একটা ফিকে জ্যোৎস্না এসে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। কেখেকে জানি হাসনাহানা ফুলের গন্ধ আসছে, মনটা বেশ খুশি খুশি লাগছে, লালমোহনবাবু আ-আ-আ করে। একটা ক্ল্যাসিক্যাল তান দিতে গিয়ে একদম বেসুরে চলে গেছেন, এমন সময় দেখলাম গেস্ট হাউসের দিক থেকে একজন লোক আমাদের দিকে আসছে। আরেকটু কাছে আসতেই চিনতে পারলাম। শুভঙ্কর বোস। জটায়ু গান থামিয়ে টান হয়ে দাঁড়ালেন। ফিসফিস করে বললেন, তোমার দাদা থাকলে ভাল হত।
আপনারাও হাওয়া খেতে বেরিয়েছেন দেখছি।
শুভঙ্করবাবুর মধ্যে একটা উসখুসে ভাব লক্ষ করলাম। দুবার গলা খাকরালেন তিনবার পিছন দিকে চাইলেন, তারপর দুপা এগিয়ে এসে গলা নামিয়ে বললেন, ইয়ে—আপনারা নীল শার্টপরা বাঙালি ভদ্রলোকটিকে চেনেন?
এর কাছে লালমোহনবাবুর কালা সাজা চলবে না, কারণ আগে অনেক কথা হয়েছে। বললেন, কই না তো। কেন, উনি কি আমাদের চেনেন বলে বললেন নাকি?
শুভঙ্কর বোস আরেকবার পেছন দিকে দেখে বললেন, লোকটি, মানে, পিকিউলিয়ার। বলছে এলোরায় প্রথম এল, আর্টে ইন্টারেস্টেড, অথচ কৈলাস দেখে একটিবার পর্যন্ত তারিফ করল না, আহা উঁহু করল না। আমি এই নিয়ে দ্বিতীয়বার এলাম, অথচ সেই প্রথমবারের মতোই থ্রিল অনুভব করলাম। ভালই যদি না লাগে তো আসাই বা কেন, আর ভান করাই বা কেন?
আমরা দুজনে চুপ। এই কথাটাই কি বলতে এলেন ভদ্রলোক?
কাছেই একটা গাছ থেকে একটানা ঝিঝি ডাকতে আরম্ভ করেছে। ছোট্ট শহরটা মনে হচ্ছে এর মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়েছে, অথচ বেজেছে মাত্র দশটা।
ইয়ে, ইদানীং খবরের কাগজ পড়েছেন? শুভঙ্কর প্রশ্ন করলেন।
কোন বলুন তো? জটায়ু জিজ্ঞেস করলেন।
ভারতবর্ষের শিল্পসম্পদ নিয়ে ব্যবসা শুরু হয়েছে। মন্দির থেকে মূর্তি লোপাট হয়ে যাচ্ছে।
সত্যি? খবরটা জানতুম না তো! কী অন্যায়! ছিছিছি।
লালমোহনবাবুর অ্যাকটিং খুব পাকা নয়, তাই একটু অসোয়াস্তি লাগছিল। কিন্তু শুভঙ্কর বোসের সেদিকে লক্ষই নেই। আরেক পা এগিয়ে এসে বললেন, ভদ্রলোক কিন্তু গেস্ট হাউস থেকে বেরিয়ে গেছেন।
কোন ভদ্রলোক?
মিস্টার মল্লিক।
বেরিয়ে গেছেন?
প্রশ্নটা আমরা দুজনে একসঙ্গে করলাম। সত্যি, ফেলুদার এখানে থাকা উচিত ছিল।
একবার যাবেন নাকি? শুভঙ্কর বোসের চোখ জ্বলজ্বল করছে।
এখন? কোথায়? লালমোহনবাবুর গলা শুকিয়ে গেছে।
গুহার দিকে।
গুহায় পাহারা নেই? লালমোহনবাবু জিজ্ঞেস করলেন।
আছে, তবে চৌত্ৰিশটা গুহার জন্য মাত্র দুজন লোক। কাজেই বুঝতেই পারছেন। আর ভদ্রলোক একটা ব্যাগ নিয়ে ঘোরেন-লক্ষ করেছেন তো? উনি আর আপনাদের বাংলোর হিপি-টাইপের লোকটি-দুজনেই ব্যাগ নিয়ে ঘোরেন। ওরও কিন্তু ভাবগতিক ভাল না। উনি কে সেটা জানতে পেরেছেন?
লালমোহনবাবু বিষম খেতে গিয়ে সামলে নিলেন।
উনি? উনি ফটোগ্রাফ তোলেন। ফাস্ট ক্লাস ফটো। আমাদের দেখিয়েছেন। এলোরার ফটা তুলছেন। চুংকিং-এর কী একটা পত্রিকার জন্য।