আমরা ডান দিকের প্যাসেজ দিয়ে হাঁটতে শুরু করেছি, আর ফেলুদা বিড়বিড় করে ইনফরমেশন দিয়ে চলেছে—
জায়গাটা তিনশো ফুট লম্বা, দেড়শো ফুট চওড়া.মন্দিরের হাইট একশো ফুট.দু লক্ষ টন পাথর কেটে সরানো হয়েছিল.প্রথমে তিন দিকে পাথর কেটে খাদ তৈরি করে তারপর চূড়ো থেকে শুরু করে কািটতে কাটতে নীচ পর্যন্ত নেমে এসেছিল. দেব দেবী মানুষ জানোয়ার রামায়ণ মহাভারত কিছুই বাদ নেই। এখানে। ক্যালকুলেশনের কথাটা একবার ভেবে দ্যাখ..আর্ট ছেড়ে দিয়ে শুধু এঞ্জিনিয়ারিং-এর দিকটা দ্যাখ…
ফেলুদা আরও বলত, কিন্তু হঠাৎ একটা শব্দ পেয়ে থেমে আমাদের দুজনের থেকে পাঁচ হাত পিছিয়ে গিয়ে একটা গহ্বরের মধ্যে রাবণের কৈলাস নাড়ার মূর্তিটা দেখতে লাগল।
পায়ের শব্দ। মন্দিরের পিছন থেকে শুভঙ্কর বোস বেরিয়ে এলেন। তাঁর হাতে একটা নাটবুক, কাঁধে একটা ঝোলা। ভারী মন দিয়ে মন্দিরের কারুকার্যগুলো দেখছেন তিনি। এবার মূর্তি ছেড়ে আমাদের দুজনের দিকে এল তাঁর দৃষ্টি। প্রথমে একটা হাসি, তারপরেই একটা উদ্বেগের ভাব।
তোমার দাদার কোনও খবর পেলে না? যতদূর পারি স্বাভাবিকভাবে বললাম, উনি একটা জরুরি কাজে হঠাৎ বম্বে চলে গেছেন। আজকালের মধ্যেই ফিরবেন।
ও…
শুভঙ্কর বোসের চোখ আবার পাথরের দিকে চলে গেল। পিছনে একটা খচা শব্দ পেয়ে বুঝলাম ফেলুদা একটা ছবি তুলল। ঘাড় ফিরিয়ে দেখলাম ফেলুদা আবার আমাদের দিকে
পড়লাম। এবার আরেকজন লোককে দেখতে পেলাম। গায়ে নীল শার্ট, সাদা প্যান্ট। মিস্টার জয়ন্ত মল্লিক। ইনি সবেমাত্র এসে ঢুকেছেন। চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিলেন, আমাদের দেখেই মন্দিরের দেয়ালে একটা হাতির মূর্তির দিকে এগিয়ে গেলেন। এর হাতের ব্যাগটা কলকাতাতেও দেখেছি। বারাসত থেকে ফেরার পথে এই ব্যাগ তার গাড়িতে ছিল, এই ব্যাগ নিয়ে উনি কুইনস ম্যানসনে নেমেছিলেন। ওটাতে কী আছে জানিবার জন্য প্রচণ্ড কৌতূহল হল। ফেলুদা আমাদের কাছাকাছি এসে গেছে। এক এক সময় ইচ্ছে করছিল ফেলুদা সোজা গিয়ে মল্লিকের কলারটা চেপে ধরে বলুক—কই, বার করুন মশাই যক্ষীর মাথা।—কিন্তু এটা বুঝতে পারছিলাম যে ও ও-রকম কাঁচা কাজ করবে না। মল্লিক সিদিকপুরে গিয়েছিল সেটা ঠিক; এখন এলোরায় এসেছে সেটা ঠিক, আর বম্বেতে কাকে জানি ফোন করে বলেছিল, মেয়ে শ্বশুরবাড়ি থেকে বাপের বাড়ি চলে এসেছে—সেটাও ঠিক। কিন্তু এর বেশি কিছু ওর সম্বন্ধে এখনও জানা যায়নি। আরেকটু না জেনে, আরেকটু প্রমাণ না পেয়ে ফেলুদা কিছু করবে না।
যেটা এখনই করা যায় সেটা অবিশ্যি ফেলুদা করল। মল্লিকের পাশ দিয়ে যাবার সময় নিজের শরীর দিয়ে ভদ্রলোকের ব্যাগটায় একটা ধাক্কা দিয়ে সরি বলে একটা মূর্তির দিকে ক্যামেরা ঘুরিয়ে ফোকাস করতে লাগল।
ধাক্কা খেয়ে ব্যাগটা যেভাবে নড়বড় করে উঠল, তাতে মনে হল না তার ভিতরে কোনও ভারী জিনিস রয়েছে।
কৈলাস থেকে বেরিয়ে এসে দুজন লোককে দেখতে পেলাম। একজন আমাদের বাংলোর এলাহাবাদি বাবু, আরেকজন হলেন সেই টেকে সাহেব! বাবু হাত নেড়ে কথা বলছেন, সাহেব মাথা নেড়ে শুনছেন। হঠাৎ কেন জানি মনে হল-আমরা তিনজন ছাড়া যত জন লোক এখানে এসেছে সবাই গোলামেলে, সবাইকেই সন্দেহ করা উচিত। ফেলুদাও কি তাই করছে?
০৭. কৈলাস থেকে ফেরার পথে
কৈলাস থেকে ফেরার পথে ফেলুদার হঠাৎ কেন জানি গেস্ট হাউসে যাবার ইচ্ছে হল। কারণ জিজ্ঞেস করতে বলল, একবার খোঁজ করে আসি এখানে খবরের কাগজ আসে। কি না। আমরা বাংলোয় চলে গেলাম। আমাদের দুজনেরই খিদে পাচ্ছিল, তাই লালমোহনবাবু চৌকিদারকে হাঁক দিয়ে চা আর বিস্কুট অর্ডার দিলেন। সামনের দরজা দিয়ে ঢুকেই ডাইনিং রুম। তার ডান দিকের এক নম্বরের ঘরটা আমাদের। আমাদের পরের ঘরটা দু নম্বর, সেটা খালি। ডাইনিং রুমের উলটা দিকে আরও দুটো ঘর। তার মধ্যে আমাদের ঠিক উলটা দিকের ঘরটায় থাকেন এলাহাবাদি, আর তার পাশের চার নম্বরে ফেলুদা।
আগেই বলেছি, লালমোহনবাবুকে মাঝে মাঝে গোয়েন্দাগিরিতে পেয়ে বসে। ওঁর এখন বোধ হয়। সেই রকম একটা মেজাজ এসেছে। ঘরে বসে চা খেতে খেতে বললেন, সাহেবকে না হয় ছেড়েই দিলাম; অন্য যে তিনজন আছে তার মধ্যে দুজনের বিষয় তো তবু কিছু জানা গেছে-সত্যি হোক মিথ্যে হাক।–কিন্তু আমাদের বাংলোর বাবুটির তো নাম পর্যন্ত জানা যায়নি। ওঁর ঘরটায় একবার উকি দিয়ে এলে হত না? মনে হল দরজায় চাবি লাগায়নি।
আমার আইডিয়াটা ভাল লাগছিল না, তাই বললাম, চৌকিদার যদি দেখে ফেলে।
লালমোহনবাবু বললেন, আমি যাই, তুমি পাহারা দাও। চৌকিদার। এদিকে আসছে মনে হলে গলা খাকরানি দিলেই আমি চলে আসব। তোমার দাদার কাজ একটু এগিয়ে রাখতে পারলে উনি খুশিই হবেন। এলাহাবাদির সুটকেসটাও রীতিমতো ভারী বলেই মনে হল।
আমি এরকম ব্যাপার কখনও করিনি। অন্তত ফেলুদা ছাড়া অন্য কারুর জন্য নয়। কিন্তু ব্যাপারটার মধ্যে একটা অ্যাডভেঞ্চারের গন্ধ থাকায় শেষ পর্যন্ত রাজি হয়ে গেলাম। আমি চলে গেলাম পিছনের বারান্দায়। সামনে একটা খোলা জায়গার পরেই বাবুর্চিখানার পাশে চৌকিদারের ঘর। চৌকিদারের একটা সাইকেল আছে আগেই দেখেছি, এখন দেখলাম তার দশ বারো বছরের ছেলেটা খুব মন দিয়ে সেটাকে পরিষ্কার করছে। একটা ক্যাঁচ শব্দ পেয়ে ঘাড় ফিরিয়ে আড় চোখে দেখলাম, লালমোহনবাবু চারের মতো তিন নম্বর ঘরে ঢুকলেন। মিনিট তিনেক পরে আমার বদলে উনিই একটা গলা খাকুরানি দিয়ে বুঝিয়ে দিলেন যে ওঁর তদন্তের কাজ শেষ। ঘরে ফিরে যেতে ভদ্রলোক বললেন, পুরনো সুটকেস, ভাবলুম হয়তো চাবি লাগে না, কিন্তু টান দিয়ে খুলল না। টেবিলের ওপর দেখলুম একটা চশমার খাপ—তাতে কলকাতার স্টিফেন কোম্পানির নাম, একটা সোড়া মিন্টের বোতল, আর একটা ওডোমসের টিউব। আলনায় সবুজ ডোর-কাটা শার্ট আর পায়জামা, মেঝেতে এক জোড়া পুরনো চটি—কোম্পানির নাম উঠে গেছে। এ ছাড়া আর কিছু–