উগ্ৰ গন্ধ তাদের শক্ৰদের হাত থেকে বাঁচিয়ে রাখে। যারা অপেক্ষাকৃত নিরীহ জানোয়ার যেমন হরিণ বা খরগোশ-প্রকৃতি তাদের দিয়েছেন দ্রুতবেগে পলায়নের ক্ষমতা। অবিশ্যি এই নিয়মেরও ব্যতিক্রম আছে। সব জানোয়ার শত্রুর হাত থেকে সমান নিরাপদ নয়।
তুমি বলছ তোমার এই জন্তু আত্মরক্ষার উপায় জানে?
প্রশ্ন করলেন কাসপার। আমি বললাম, তার দুটো পরিচয় আমি পেয়েছি। গোখরো সাপের আক্রমণ থেকে সে যে শুধু নিজেকে বাঁচিয়েছে তা নয়, সাপকে সে যুদ্ধে পরাজিত করেছে। আর শীতের প্রকোপ থেকে সে কীভাবে নিজেকে বাঁচিয়েছে সে তো চোখের সামনেই দেখতে পাচ্ছি। আত্মরক্ষার তাগিদেই ক্রমবিবর্তনের ফলে যে পৃথিবীর প্রাণীর রূপ পালটেছে সে তো জানোই। আদিম জলচর প্রাণীই জলের যখন অভাব হল তখন প্রথমে হল উভচর। তারপর স্থলচর। সরীসৃপের ডানা গজিয়েই হল প্রথম উড়ন্ত জানোয়ার-সেও তো পরিবেশ বদলের জন্যই। এসব পরিবর্তন হতে কোটি কোটি বছর লেগেছিল। পরিবর্তিত অবস্থার সঙ্গে খাপ খাওয়ানোটা তো চোখের নিমেষে হয় না।
কিন্তু তোমার জানোয়ারের ক্ষেত্রে সেটাই হয়েছে? বললেন কাসপার।
তাই তো দেখলাম চোখের সামনে।
কথাটা কাসপার বিশ্বাস করলেন বলে মনে হল না। আমি ভেবেছিলাম। একহার্ট আমাকে সাপোর্ট করবেন, কিন্তু তাঁকেও ভ্ৰকুঞ্চিত দেখে কিঞ্চিৎ বিস্মিত হলাম।
প্রাতরাশের পর একহার্ট প্রস্তাব করলেন তাঁর বিস্তীর্ণ বাগানটা একটু ঘুরে দেখে আসার জন্য। রাত্ৰে তুষারপাতের ফলে সেই বাগানে এখন বরফের গালিচা বিছানো রয়েছে, সেটা সকালে উঠে জানালা দিয়ে দেখেছি।
আমি প্রস্তাবে আপত্তি করলাম না।
বাগানটা যে কতখানি জায়গা জুড়ে তা আমার ধারণা ছিল না। অবিশ্যি সবটাকেই বাগান বললে ভুল হবে। ফুলগাছের পাট কিছুদূর গিয়েই শেষ হয়ে গেছে, তারপর সবই বড় বড় গাছ, তার মধ্যে অধিকাংশই পাইন জাতীয়। এটাকে বন বললেই ঠিক বলা হবে।
আমি একহার্টকে প্রাণিতত্ত্ব বিষয়ে একটা প্রশ্ন করতে যাচ্ছিলাম, এমন সময় জানোয়ারের কণ্ঠস্বর শুনে সেটা আর করা হল না।
হাউন্ডের ডাক। অ্যালসেশিয়ান।
হানসেল আর গ্রেটেলও দেখছি বেড়াতে বেরিয়েছে, বললেন একহার্ট।
আমি প্রথমে ইয়ের হাত ধরে হাঁটছিলাম, তারপর নিজেই হাতটা ছেড়ে দিয়েছিলাম। এখন তার দিকে আড়াচোখে চেয়ে দেখি তার ভুরু কুঁচকে গেছে।
এবার প্রায় একশো গজ দূরে কুকুরদুটোকে দেখতে পেলাম। দুটোর গলাতেই বকলস, চামড়ার দড়ি একহার্টের চাকরের হাতে ধরা।
কুকুর আর আমরা পরস্পরের দিকে এগিয়ে চলেছি। দূরত্ব যখন আন্দাজ ত্রিশ গজ, তখন অ্যালসেশিয়ান দুটো থেমে গেল, তাদের দৃষ্টি সটান ইয়ের দিকে। আমরা চারজনেও থেমে গেছি। আমি ইয়ের দিকে এগিয়ে গিয়ে তার হাতটা ধরে নিলাম। কাসপার ও একহার্ট বুঝতেই পারছি, ঘটনা কোন দিকে যায়। তাই দেখার জন্য অপেক্ষা করছেন।
দুটো কুকুরের দড়িতেই যে টান পড়ছে সেটা আমি লক্ষ করছিলাম, আর সেইসঙ্গে মৃদু। হুংকারও শুনতে পাচ্ছিলাম মাঝে মাঝে।
হঠাৎ প্রচণ্ড হ্যাঁচকা টানে একহার্ট-ভৃত্যকে বরফের উপর ফেলে দিয়ে হানসেল আর গ্রেটেল ছুটে এল আমাদের দিকে, আর ঠিক সেই মুহুর্তে আমার হাতে একটা টান অনুভব করাতে দেখলাম ইয়ে বিদ্যুদ্বেগে বাঁদিকে ছুটে গিয়ে একটা তুষারাবৃত ঝোপের পিছনে অদৃশ্য
হয়ে গেল।
সে ভয় পেয়েছে। এই জোড়া প্রতিদ্বন্দ্বীকে পরাস্ত করার ক্ষমতা প্রকৃতি তাকে দেয়নি।
প্রায় যন্ত্রের মতোই আমিও ছুটে গেলাম ইয়ের পিছনে, আর আমার পিছনে একহার্ট ও কাসপার।
কুকুর দুটোর হিংস্ৰ চাহনি আগেই লক্ষ করেছিলাম; এবার দেখলাম শিকারের লোভে তাদের পাগলের মতো ছোটাছুটি। তারা হন্যে হয়ে খুঁজছে আমার জন্তুকে।
আমি প্ৰমাদ গুনলাম। বাধ্য হয়ে চেঁচিয়ে বলতে হল, দোহাই ড়, একহার্ট, আপনার কুকুরদুটোকে থামান।
ইমপিসিবল, রুদ্ধস্বরে বললেন একহার্ট, এ অবস্থায় ওদের থামানো ভগবানের অসাধ্য।
কিন্তু আশ্চৰ্য ব্যাপার-যেদিকে ইয়ে গিয়েছিল। সেইদিকেই গিয়েছে কুকুরদুটো, কিন্তু আমার সেই পোষা অনুগত জানোয়ারের কোনও চিহ্ন নেই।
প্রায় পাঁচ মিনিট উদ্দাম দাপাদাপির পর হানসেল আর গ্রেটেল হাল ছেড়ে দিয়ে জিভ বার করে হাঁপাতে লাগল, আর তাদের পরিচালক এগিয়ে গিয়ে কুকুরের গলার দড়ি হাতে তুলে নিল।
ওদের বাড়িতে নিয়ে যাও, হুকুম করলেন একহার্ট।
কিন্তু তোমার জানোয়ার কোথায় উধাও হল? প্রশ্ন করলেন কাসপার।
আমিও অবিশ্যি সেই কথাই ভাবছিলাম। অথচ আশেপাশে মাটিতে গর্ত বা গাছের গায়ে ফোকরও নেই যাতে তার ভিতর লুকোনো যায়।
কুকুরদুটো প্রায় বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছোনোর পর আত্মপ্রকাশ করলেন আমার আশ্চর্য জানোয়ার।
কিন্তু এ কী হয়েছে তার চেহারা? সে কি এতক্ষণ বরফে গড়াগড়ি করেছে?
না, তা নয়। তার গায়ের রং, তার চোখের মণি, তার মাথা থেকে পা পর্যন্ত সর্বাঙ্গ হয়ে গেছে। ধবধবে সাদা। সে এখন একটা তুষারপিণ্ডের সামিল। এই অবস্থায় এই পরিবেশে তাকে খুঁজে পাওয়া অসম্ভব।
গট ইন হিমেল! চেঁচিয়ে উঠলেন। কাসপার। হ্যাঁ, ঈশ্বরের নাম উচ্চারণ এই অবস্থায় স্বাভাবিক। এমন আশ্চৰ্য ঘটনা দুই জার্মান নিশ্চয়ই কোনওদিন দেখেননি।
আমরা চারজন আবার একহার্ট কাসলে ফিরে এলাম। সবাই মিলে সোফায় বসতে কাসপারই প্রথম মুখ খুললেন।
তোমার এই মহামূল্য সম্পত্তির ভবিষ্যৎ কী তা তুমি স্থির করেছ?