বিশ্বাস হল? বিশ্বাস হল?
ক্রাগের আস্ফালনে অপারেটিং রুমের কাচের জিনিস ঝনঝনি করে উঠল।
আমিই যে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক সে কথা বিশ্বাস হল?
আমরা দুজনেই চুপ, এবং ক্রাগও যে মৌনং সন্মতি লক্ষণম বলে ধরে নিলেন, সেটা বেশ বুঝতে পারলাম, কারণ তাঁর মুখে ফুটে উঠল এক পৈশাচিক হাসি। কিন্তু পর মুহুর্তেই সে হাসি মিলিয়ে গেল। সে একদৃষ্টি আমাদের দুজনের দিকে দেখছে। তারপর তার দৃষ্টি চলে গেল দরজার দিকে।
পাপাডোপুলস…তাকে দেখছি না কেন?
এতক্ষণে খেয়াল হয়েছে ক্রাগের।
কোথায় পাপাডোপুলস? তিনি এবার প্রশ্ন করলেন। সে তোমাদের সাহায্য করেনি?
সে ভয় পাচ্ছিল, বলল সামারভিল। তাকে আমরা রেহাই দিয়েছি।
ক্রাগের মুখ থমথমে হয়ে গেল।
কাপুরুষের শাস্তি একটাই। সে বিজ্ঞানের অবমাননা করেছে। পালিয়ে গিয়ে মুখের মতো কাজ করেছে সে, কারণ এ দুর্গে প্রবেশদ্বার আছে, কিন্তু পলায়নের পথ নেই।
এবার ক্রাগের দৃষ্টি আমাদের দিকে ঘুরল। ক্ৰোধ চলে গিয়ে সেখানে দেখা দিল এক অদ্ভুত কৌতুকের ভাব।
টেবিল থেকে ধীরে ধীরে নেমে সে আমাদের সামনে দাঁড়াল। তার দৃপ্ত ভঙ্গিতে বুঝলাম সে পুনর্জীবনের সঙ্গে সঙ্গে পুনর্যৌবন ফিরে পেয়েছে। তার গলার স্বরেও আর বার্ধক্যের কোনও চিহ্ন নেই।
থর আর ওডিনকে দিয়ে আর কোনও প্রয়োজন নেই আমার গুরুগম্ভীর স্বরে বললেন ক্রাগ। তাদের জায়গা নেবে এখন তোমরা দুজন। যান্ত্রিক মানুষের নিজস্ব বুদ্ধি সীমিত। তোমাদের বুদ্ধি আছে। তোমরা আমার আদেশ মতো কাজ করবে। যে লোক সারা বিশ্বের মানুষের উপর কর্তৃত্ব করতে চলেছে, তারই অনুচর হবে তোমরা।
ক্র্যাগ কথা বলতে বলতেই এক পাশে সরে গিয়ে একটা ছোট ক্যাবিনেটের দরজা খুলে তার থেকে একটা জিনিস বার করেছেন। একটা পাতলা রবারের মুখোশ। সেটা মাথার উপর দিয়ে গলিয়ে পরে ক্রােগ তাঁর ডান হাতটা একটা সুইচের দিকে প্রসারিত করলেন। আমি জানি সুইচটা টিপলে কোনও অদৃশ্য ঝাঁঝরি বা নলের মুখ থেকে একটি সর্বনাশা গ্যাস নিৰ্গত হবে, এবং তার ফলে আমরা চিরকালের মতো–
মাস্টার!
ক্রাগের হাত সুইচের কাছে এসে থেমে গেল। সিঁড়ির মুখে নিলস এসে হাঁপাচ্ছে, তার চোখে বিহ্বল দৃষ্টি।
প্রোফেসর পাপাডোপুলস পালিয়েছেন।
পালিয়েছে?
ক্ৰাগ যেন এ কথাটা বিশ্বাস করতে পারছে না!
ইয়েস মাস্টার। প্রোফেসর সেই বন্ধ ঘরের সামনে গিয়েছিলেন; দরজার তালা ভাঙা, তাই হেনরিক সেখানে পাহারা দিচ্ছিল। হেনরিকের হাতে রিভলভার ছিল। প্রোফেসর তাকে দেখে পালায়। হেনরিক পিছু নেয়। প্রোফেসর দুর্গের পশ্চিম দেয়ালের বড় জানালাটা দিয়ে বাইরে কার্নিশে লাফিয়ে পড়েন। প্রোফেসর অত্যন্ত ক্ষিপ্র, অত্যন্ত–
নিলসের কথা শেষ হল না। একটা নতুন শব্দ শোনা যাচ্ছে। এই শব্দ এতই অপ্রত্যাশিত যে, ক্রাগও হতচকিত হয়ে সুইচ থেকে হাত সরিয়ে নিয়েছে।
শব্দটা এবার আরও কাছে। নিলসের মুখ কাগজের মতো সাদা। সে দরজার সামনে থেকে ছিটকে সরে এল। পরমুহুর্তে একটা প্ৰকাণ্ড হুঙ্কার দিয়ে সিঁড়ি থেকে এক লাফে ল্যাবরেটরিতে প্রবেশ করল একটা জানোয়ার। ঘরের নীল আলো তার ঘোর কৃষ্ণবর্ণ মসৃণ রোমশ দেহে প্রতিফলিত। তার গলায় এখনও ঝুলছে সেই তারিখ লেখা কার্ড।
একটা অদ্ভুত গোঙানির শব্দ বেরোচ্ছে ক্রাগের মুখ থেকে। সেই শব্দ অতি কষ্টে উচ্চারিত দুটো নামে পরিণত হল—
ওডিন! থর।
ক্রাগ চেচাতে গিয়েও পারলেন না। এদিকে থর নিথর, নিষ্পন্দ।
সামারভিল থিরের হাত থেকে বিশাল হাতুড়িটা বার করে নিল। দু হাতে সেটাকে শক্ত করে ধরে দু পা পিছিয়ে গিয়ে দাঁড়াল। জানোয়ার আমাদের আক্রমণ করলে ওই হাতুড়িতে আত্মরক্ষণ হবে না জানি; আর এও জানি যে, জানোয়ারের লক্ষ্য আমাদের দিকে নয়। সে এক পা এক পা করে এগিয়ে আসছে তারই দিকে যে এত দিন তাকে বোকা বানিয়ে রেখেছিল।
বিপদের চরম মুহুর্তে আমার মাথা আশ্চর্যরকম পরিষ্কার থাকে সেটা আগেও দেখেছি। ক্রাগের ডান হাত সুইচের দিকে এগোচ্ছে দেখে, এবং সে গ্যাসের সাহায্যে বাঘ সমেত আমাদের দুজনকে বিধ্বস্ত করতে চাইছে জেনে আমি বিদুদ্বেগে এক হ্যাঁচক টানে তার মাথা থেকে মুখোশটা খুলে ফেললাম। আর সেই মুহুর্তে ব্ল্যাক প্যানথারও পড়ল তার উপর লাফিয়ে। ঊর্ধ্বশ্বাসে সিঁড়ির দিকে দৌড়ে যাবার সময় শুনলাম ক্রাগের অভ্ৰভেদী আর্তনাদ। আর তার পরমুহুর্তেই শুনলাম পরিচিত গলায় আমাদের নাম ধরে ডাক।
শঙ্কু! সামারভিল!
আমরা উপরের করিডরে পৌঁছে গেছি, কিন্তু পাপাডোপুলস কোখেকে ডাকছে সেটা চট করে ঠাহর হল না। এই গোলকধাঁধার ভিতরে শব্দের উৎস কোন দিকে সেটা সব সময় বোঝা যায় না।
সামনে ডাইনে একটা মোড়। সেটা ঘুরতেই সেই নিষিদ্ধ দরজা পড়ল। সেটা এখন খোলা। তার সামনে পা ছড়িয়ে রক্তাক্ত দেহে মরে পড়ে আছে একটি লোক। বুঝলাম ইনিই হেনরিক, এবং ইনিই প্যানথারের প্রথম শিকার।
করিডরের মাথায় এবার দেখা গেল পাপাডোপুলসকে। সে খানিকটা এসেই থমকে থেমে ব্যস্তভাবে হাতছানি দিয়ে চিৎকার করে উঠল—চলে এসো-রোড ক্লিয়ার!
আমরা তিনজনে তিনটে ঘর পেরিয়ে ওয়েটিং রুমের দরজা দিয়ে কেল্লার বাইরে এসে পড়লাম। পাপাডোপুলসের হাতের রিভলভারটি আগে নিঃসন্দেহে হেনরিকের হাতে ছিল। ওই একটি রিভলভারে পলায়ন পথের সব বাধা দূর হয়ে গেল এবং ওই একই রিভলভারে ওপেলের ড্রাইভার পিয়েট নিরভালকে বশে এনে তিনজনে গাড়িতে চেপে রওনা দিলাম অসলো এয়ারপোর্টের উদ্দেশে। পাসপোর্ট এবং রিটার্ন টিকিট সঙ্গেই আছে, সুতরাং আর কোনও বাধা নেই।