সামারভিল আমার পাশে বসে পড়ে বলল, এই তামাশায় অংশগ্রহণ করাটা কি আমাদের মতো লোকের সাজে? হাজার হোক আমরা তো একেবারে ফ্যালনা নাই!—আমাদের একটা প্রতিষ্ঠা আছে, সমাজে বিচক্ষণ ব্যক্তি বলে একটা সুনাম আছে।
আমি বললাম, দেখো জন, আমরা যখন ক্রাগের পয়সায় এখানে এসেছি, তার আতিথ্য গ্ৰহণ করেছি, তখন এত সহজে মাথা গরম করলে চলবে না। কাল সকালেই তার তিরোধান হবার কথা। দেখাই যাক না তারপর কী হয়। লোকটা বুজরুক কি না সে তো তখনই বোঝা যাবে। আর সে লোক যদি না-ই মরে তা হলে তো এমনিও কিছু করার নেই। যদিন সে না মরছে তদিন সে নিশ্চয়ই আমাদের ধরে রেখে দেবে না।
পাপাডোপুলস তার বাঁ হাতের তেলোতে ডান হাত দিয়ে একটা ঘুষি মেরে বলল, বৈজ্ঞানিক দেখাবার লোভ দেখিয়ে আমাদের কী ভাঁওতাই দিল বলে তো। ছিছিছি।
একটা ব্যাপারে আমার মনটা খচখচ করছিল, সেটা এবার না বলে পারলাম না।
আমিও তোমাদের সঙ্গে একমত হতাম, কিন্তু একটা কারণে হতে পারছি না।
কী কারণ? সমস্বরে প্রশ্ন করে উঠলেন দুজনেই।
ওডিন।
নামটা উচ্চারণ করতেই পাপাডোপুলস হাঁ হাঁ করে উঠল।
ওডিন? একটা জাঁদরেল লোককে মেকআপ করে মাথা মুড়িয়ে নাটুকে পোশাক পরিয়ে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে, তাতে খটকার কী আছে? তুমি কি ভাবছরগ টিপে শক্তি সঞ্চার করাটা বুজরুকি নয়? হুঁঃ! ক্রাগের পুরো ব্যাপারটাই ধাপ্পা। বলে দেড়শো বছর বয়স! ওর সব কথাগুলোর মধ্যে কেবল একটা সত্যি হতে পারে, সেটা হল জুয়ো খেলে পয়সা করার ব্যাপারটা। ও যে সব দামি ছবিটবি দিয়ে ঘর সাজিয়েছে, সে তো আমার মনে হচ্ছে হয় চোরাই মাল, না হয়। জাল জিনিস। কোন ডাকাতের পাল্লায় পড়েছি কে জানে।
আমি এবার আসল কথাটা বললাম।
ওডিনের চোখে পলক পড়ছিল না।
সামারভিল ও পাপাডোপুলস দুজনেই অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে আমার দিকে চাইল। তুমি ঠিক দেখেছি? প্রশ্ন করল সামারভিল।
অন্তত পাঁচ মিনিট একটানা চেয়ে ছিলাম তার দিকে। অতক্ষণ ধরে নিষ্পলক দৃষ্টি মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। আমার ধারণা ওডিন একটি যান্ত্রিক মানুষ। অর্থাৎ রোবট। এ রকম রোবটের অভিজ্ঞতা আমার এর আগেও একবার হয়েছে।
সামারভিল বলল, তা হলেও কি প্রমাণ হয় যে ক্রাগ নিজে বৈজ্ঞানিক, এবং সে নিজেই রোবটটি তৈরি করেছে?
না, তা হয় না। তার নিজের দৌড় বোঝা যাবে। যদি তার আবিষ্কৃত উপায়ে মরা মানুষকে আবার–
আমার কথা আর শেষ হল না; ঘরের বাতি হঠাৎ স্নান হয়ে প্রায় নিভে গিয়ে ঘর অন্ধকার হয়ে গেছে। জানালার পরদা টানা, তাই ঘরে আলো ঢুকছে না।
কী ব্যাপার? বলল পাপাডোপুলস। হঠাৎ কী করে—
পাপাডোপুলসের প্রশ্ন ছাপিয়ে একটা গুরুগম্ভীর অশরীরী কণ্ঠস্বর ঘরটাকে কাঁপিয়ে দিল। দ্য মাস্টার ইজ ডেড। তারপর কয়েক মুহুর্ত নৈঃশব্দ। পাপাডোপুলসের মুখ ফ্যাকাশে। সামারভিল সোফা ছেড়ে দাঁড়িয়ে উঠেছে। তারপর আবার সেই কণ্ঠস্বর।
দ্য মাস্টার উইল লিভ এগেন।
কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই ঘরের বাতি আবার আগের অবস্থায় ফিরে এল।
এই ঘরের মধ্যেই কোথাও একটা স্পিকার লুকোনো রয়েছে বলল পাপাডোপুলস।
সেটা তো বোঝাই যাচ্ছে বলল সামারভিল, কিন্তু খবরটা সত্যি কি না এবং ভবিষ্যদ্বাণী ফলবে কি না সেটাই হচ্ছে প্রশ্ন।
পাপাডোপুলস চেয়ারে বসে ছিল, এবার উঠে পায়চারি করতে করতে বলল, ভদ্রলোকের নাটুকেপনা সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে।
কথাটা ভুল বলেনি। আমারও এখানে এসে অবধি সেটা অনেকবার মনে হয়েছে। আজ যখন নিলসের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে কাসলের ঘরগুলো দেখছিলাম তখনও এটা মনে হচ্ছিল। বিংশ শতাব্দীতে এ রকম একটা দুর্গের পরিকল্পনাটাই নাটুকে। ওই যে একটা ঘরের দরজায় বিশাল একটা তালা ঝুলিয়ে ঘরটা বন্ধ করে রাখা হয়েছে, ওটাই বা কি কম নাটুকে? পাপাডোপুলস বলছিল। ঘরে চোরাই মাল রাখা আছে; কিন্তু আমার সেটা বিশ্বাস হয় না। বিশ্বের কোনও নাম করা মিউজিয়াম থেকে ক্রাগ যদি কিছু চুরি করে থাকে, তা হলে সে খবর কাগজে বেরোত, এবং সেটা আমরা জানতাম। হয়। ক্রাগ অকারণে রহস্য করছে, না হয় সত্যিই গোপনীয় কিছু রাখা আছে ওই ঘরে।
ঘড়ি ধরে রাত আটটায় নিলস এসে খবর দিল ডিনার রেডি। রাজভোগ্য আহার। যে লোকটা পরিবেশন করছিল তাকেও দেখে অত্যন্ত প্ৰাচীন বলে মনে হচ্ছিল; কিন্তু সে কত দিন হল ক্রাগের কাজ করছে সে কথা জিজ্ঞেস করার ভরসা পেলাম না। তিনজনের একজনও। মরে গিয়ে বেঁচে ওঠা লোকের হাতে পরিবেশন করা খাবার খাচ্ছি জানলে সে খাবার যতই সুস্বাদু হোক, পেটে গিয়ে হজম হত না।
সাড়ে আটটা নাগাত পরস্পরকে গুড নাইট জানিয়ে আমরা যে যার ঘরে চলে গেলাম।
ঘরে এসে পরদা সরিয়ে বাইরে সূর্যের আলো আছে কি না দেখতে গিয়ে দেখি ঘরটা আসলে কেল্লার ভিতর দিকে। বাইরেটায় আকাশের পরিবর্তে রয়েছে একটা অন্ধকার করিডর। একটা দেওয়াল দেখতে পাচ্ছি; মনে হয়, সেটা হাত দিশেকের মধ্যে। দেওয়ালের দিকে পিঠ করে দাঁড়িয়ে আছে একটা বৰ্ম আটা যোদ্ধার মূর্তি।
আমি খাটে এসে বসলাম। কাল কপালে কী আছে কে জানে। একটা কথা বার বারই মনে হচ্ছে; ক্রাগের একটা উক্তি
আমার আসল কাজই এখনও বাকি। আমার শেষ অ্যাডভেঞ্চার…
কী কাজের কথা বলতে চায় আলেকজান্ডার অ্যালয়সিয়াস ক্রাগ?
সে অ্যাডভেঞ্চারে আমাদের কোনও ভূমিকা আছে কি?
এই বন্দিদশা থেকে আমাদের মুক্তি হবে কবে?