.
অনুপমার ঘুম ভেঙেছে অনেকক্ষণ, সমস্ত বিছানাময় বালি কিরকির করছে, দাঁতে ধুলো, চুলে ধুলো। বিছানার চাদর উলটে গেছে হাওয়ায়। জানালার পাল্লাগুলো মড়মড় করছে, একটা পাল্লা ব্যাং খুলে ঠাস করে শব্দ করল। খড়কুটো উড়ে পড়েছিল কিছু, ভেন্টিলেটারে পাখির বাসা দমকা হাওয়ায় খসে পড়ল বিছানায়! চমকে উঠে মনোরমার নাম ধরে চেঁচাতে যাচ্ছিল সে, ঠিক সে সময়ে বাইরের রংটা চোখে পড়ল। শালিকের পায়ের মতো হলুদ এ কেমন রং? হলুদ রংটাই কেমন শিরশিরানি তুলে দেয় শরীরে। মনে পড়ে হুলুধ্বনি, শাঁখের আওয়াজ, মাঘের দুপুরে উঠোনে পিঁড়ির উপর দাঁড়িয়ে শীতল জলে সেই রোমাঞ্চকর স্নান। হলুদ সেই রংটা কে ঢেলে দিয়েছে চারধারে এখন! পাখির বাসাটা আপনিই গড়িয়ে পড়ে গেল মেঝেয়। আজকাল বড্ড মনে পড়ে। বাতাস বয় উলটোবাগে, ঠিক সেইসব পুরোনো কথা ধুলো বালির মতো উড়িয়ে আনে, ঘরময় ছড়িয়ে দিয়ে যায়! সে এক বাতাস অনুপমার বুকের ভিতরে দমকা মেরে ঘোরে, ঝড় ওঠে। আজকাল বড্ড মনে পড়ে।
পাশ ফিরতে অনুপমা কুসি ছানাটাকে দেখতে পেল। আহা রে, কতটুকু চড়াইয়ের ছানা। একটা, মুখে বোল ফোটেনি তবু বারবার হাঁ করছে। সদ্য জন্মেছে বলে গায়ের পাতলা চামড়ায়। এখনও রোঁয়া ওঠেনি, রাঙা শরীর কাত করে পড়ে আছে বিছানায়, অনুপমার পায়ের পাতার পাশেই। আর একটু হলে চাপা পড়ত।
অনুপমার উঠে বসতে বড় কষ্ট হয়। বুক ধড়ফড় করে। পাখির ছানাটার দিকে হাত বাড়ায়। ঠিকই, ধরতে সাহস হয় না। কতটুকু ওর শরীর। ডিমসুতোর গুলির মতো একটুখানি। এমন পলকা জীব ধরতে ভয় করে। যদি হাতের চাপে মারা যায়!
বৈশাখী ঝড়ের একটা ঝাঁপটা এসে লাগে বড় নারকেল গাছে। ডগাশুদ্ধ বিশাল একটা শুকনো নারকেল পাতা টিনের চালের ওপর হুড়মুড় করে খসে পড়ে। অনুপমা আজকাল আর চমকায় না।
চড়াইয়ের ছানাটা হাঁ করে আছে। তেষ্টা পেয়েছে নাকি? তোর মা মুখপুড়ি কোথায় রে? আহা কাঁপছে দ্যাখো থিরথির করে। অনুপমা সাবধানে হাত বাড়িয়ে চড়াই ছানাটাকে তুলে নেয়!
সরু কাঠির মতো দু-খানা পা, ছুঁচের মতো সরু নখ তাই দিয়ে ছানাটা অনুপমার একটা আঙুল আঁকড়ে ধরল। শিউরে উঠে বে–খেয়ালে হাত ঝেড়ে ছানাটাকে ফেলে দিল অনুপমা, চেঁচিয়ে ডাকল–মনো, শিগগির আয়।
কেউ শুনল না, শুকনো পাতা উড়ছে, বৃষ্টির ফোঁটা ফাটছে চড়বড় করে টিনের চালে–তার শব্দে অনুপমার গলা ডুবে গেল। জানলার জালের নীচে ছোট্ট ফোকর, সেই ফোকরটা দিয়ে পাখির ছানাটা গলে বাইরে গিয়ে পড়েছে। বাইরে ঝড়।
অনুপমা ঝড়ের বাতাস উপেক্ষা করে বিছানায় কষ্টে হাঁটু গেড়ে বসে জানলা দিয়ে বাইরেটা দেখছিল। জানালার ধারে নর্দমা, নর্দমার পাশে-পাশে ডুমুরের গাছ কচুর ঝোঁপ, ভাঙের জঙ্গল। কোথায় গিয়ে পাখিটা পড়ল!
বাইরে সেই অদ্ভুত আলোটি, হলুদ। পাখিটা খুঁজতে-খুঁজতে অনুপমা অন্যমনস্ক হয়ে গেল। আলোটা তার গায়ে কেমন আভা ছড়িয়েছে! ইচ্ছে করল এই আলোতে হাত–আয়নায় একবার নিজের মুখটা দেখে।
অনুপমার ঘরের জানালাগুলো বন্ধ করেছে মনোরমা। এখন বিছানাটা ঝাড়ছিল।
অনুপমা নিস্তেজ গলায় জিগ্যেস করে–শানু উঠেছে?
–না! ঠান্ডা বাতাস পেয়ে ঘুমোচ্ছে। আরও একটু ঘুমোবে আজ।
অনুপমার একবার বলতে ইচ্ছে হল–শানু উঠলে ওকে সবজির ঝোলটা খাওয়াস মনে করে। তারপর ভাবল, মনোই তো খাওয়ায়, ঘুম পাড়ায়, সব করে। বলার দরকার কী? গত দু-মাস ধরে মননাই তো সব করছে! শানু অনুপমার কাছে বড় একটা আসে না আজকাল।
–একটা পাখির বাসা বিছানায় পড়েছিল, একটা চড়াইছানা শুদ্ধ। চড়াইছানাটাকে ধরতে গিয়ে বাইরে ফেলে দিয়েছি। বৃষ্টিটা থামলে একটু ঘরের পেছনে গিয়ে দেখিস তো?
–ফেলে দিলে? কাকগুলো ঠুকরে কিছু রাখবে নাকি? নইলে বেড়াল মুখে করে নিয়ে যাবে।
–ধরতে গিয়েছিলাম, আঙুলটা সরু পায়ে আঁকড়ে ধরল এমন! মাগো বলে চমকে হাত ঝাড়লাম, ছিটকে বাইরে পড়ে গেল। বাঁচবে না ঠিকই, তবু দেখিস তো একটু। কুসি ছানাটা, মা পাখিটা রাতে এসে কাঁদবে হয়তো।
মনোরমা বলে–এ পাশটা বৃষ্টির ছাঁটে একটু ভিজে গেছে দিদি।
–ভিজুকগে। বড় বিছানা, আমি তো একটা পাশে পড়ে থাকি।
–ঠান্ডা বাতাস দিচ্ছে, তুমি একটা কিছু গায়ে দিয়ে শোও। একটা কাঁথা বের করে দেব?
–থাকগে, একটু জুড়োই কিছুক্ষণ। পিঠটা ঘামাচিতে ভরে গেছে। চা করবি নাকি? করলে একটু দিস।
–এক্ষুনি করব? চা খাওয়ার একজন লোক তো বিকেলে আসেই, সে এলে একেবারে করতাম।
–তোটন কি আজ আসবে? যা বৃষ্টি!
পালকের ঝাড়নে খাটের বা জ্বর মিহি ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে মনোরমা মুখ লুকিয়ে হাসে। আসবে না আবার! না এসে পারে নাকি?
–তোর জামাইবাবুর ছবিটা মুছিস। মালাটা শুকিয়ে গেছে, ফেলে দিস।
ছবিটার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মনোরমার বুকটা কেমন করে। অভিরামদা তেমন সুন্দর ছিল না। মোটাসোটার ওপরে চেহারা, প্রকাণ্ড গোঁফ ছিল, মুখখানা সাধারণ। কিন্তু এসবে কিছু যায় আসে না। পৃথিবীতে কোটি–কোটি পুরুষ আছে, তবু তার মধ্যে ওই একজনই ছিল অনুপমার মানুষ। আলাদা মানুষ, একার মানুষ, নিজের মানুষ। মাসদুই আগে অভিরামদা মারা গেছে, অনুপমা তারপর থেকে আজও বিছানা ছাড়েনি। সেই কালিকাপুর থেকে মনোরমা এসে আছে টানা দু মাস। শানুকে রাখে, অনুপমার দেখাশুনা করে। অভিরামদা বাড়িটা করে না গেলে দিদি আজ অবশ্যই কালিকাপুরে বাপের বাড়ির গলগ্রহ হয়ে থাকত। অল্পবয়সেই বাড়ি করেছিল অভিরামদা। তোটন পারবে কি? ছাই পারবে। এখনও চাকরিই পেল না।