কিন্তু মুশকিল হল, এত বড় বাড়িতে কালীচরণ একা। সারাদিন কথা বলার লোক নেই।
কালীচরণ তাই গ্রাম থেকে গরিব বুড়ো একজন মানুষকে চাকর রাখল। বাগান দেখবে, জল তুলবে, কাপড় কাঁচবে, রান্না করবে। কালীচরণও কথা কইতে পেয়ে বাঁচবে।
লোকটা দিন-দুই পর একদিন রাতে ভয় খেয়ে ভীষণ চেঁচামেচি করতে লাগল। সে নাকি ভূত দেখেছে।
কালীচরণ খুব হাসল কাণ্ড দেখে। বলল, দূর বোকা, কোথায় ভূত?
কিন্তু লোকটা পরদিন সকালেই বিদেয় হয়ে গেল। বলল, সারাদিন জল খেয়ে থাকলেও এ বাড়িতে আর নয়।
কালীচরণ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল মাত্র। কিছুদিন আবার একা। কিন্তু কঁহাতক ভালো লাগে। অগত্য কালীচরণ একদিন শহরে গিয়ে নিজের বউকে বলল, একবার চলো দেখে আসবে। সে বাড়ি দেখলে তোমার আর আসতে ইচ্ছে হবে না।
কালীচরণের বউয়ের কৌতূহল হল। বলল, ঠিক আছে চলল। একবার নিজের চোখে দেখে আসি কোন তাজমহল বানিয়েছ।
গায়ে এসে বাড়ির শ্রীছাঁদ দেখে কিন্তু বউ ভারি খুশি। ছেলেমেয়েদেরও আনন্দ ধরে না।
কিন্তু পয়লা রাত্তিরেই বিপত্তি বাধল। রাত বারটায় বড় মেয়ে ভূত দেখে চেঁচাল। রাত একটায় ছোট মেয়ে ভূতের দেখা পেয়ে মূর্ছা গেল। রাত দুটোয় দুই ছেলে কেঁদে উঠল ভূত দেখে। রাত তিনটেয় কালীচরণের বউয়ের দাঁতকপাটি লাগল ভূত দেখে।
পরদিন সকালেই সব ফরসা। বাচ্চা কাচ্চা নিয়ে শহরে রওনা হওয়ার আগে বউ বলে গেল, আর কখনও এ বাড়ির ছায়া মাড়াচ্ছি না।
কালীচরণ আবার দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর আপনমনে বলল, কোথায় যে ভূত, কীসের যে ভূত, সেটাই তো বুঝতে পারছি না।
কুস্তির প্যাঁচ
যে লোকটা রোজ ভোররাতে উঠে দেড়শো বুকডন আর তিনশো বৈঠক দেয়, তারপর জিমনাস্টিকস করে, বালির বস্তায় ঘুষি মারে এবং কুংফু ক্যারেট জুডো অভ্যাস করে, তার আবার মর্নিংওয়াকের কি প্রয়োজন, এটা অনেকেরই প্রশ্ন। কিন্তু গোয়েন্দা বরদাচরণ এর জবাব দিতে পারবেন না। তবে এটা ঠিক যে, আজও প্রতিদিন সকালে তাকে দাদুর সঙ্গে প্রাতঃভ্রমণে যেতে হয়। যখন থেকে হাঁটতে শিখেছেন, সেই তখন থেকে আজ অবধি রোজ।
বরদাচরণের দাদুর বয়স পঁচাশি। যৌবনকালে নামকরা কুস্তিগির ছিলেন। অনেক মেডেল কাপ শিল্ড পেয়েছেন। এখনও শালগাছের মতো ঋজু ও প্রকাণ্ড শরীর। রোজ কুড়ুল চালিয়ে দু’মন করে কাঠ কাটেন। পুকুরে ঘণ্টাখানেক সাঁতরান। কুয়ো থেকে বিশ-ত্রিশ বালতি জল তোলেন। যৌবনে গোটা একটা খাসির মাংস খেয়ে ফেলতে পারতেন! ডিম খেতেন দু’ডজন করে। আধ সের ঘি। পাঁচ সের দুধ। এখন আর অত খান না। তবু যা খান, তা তিনটে লোকের খোরাক। সকালে উঠে পরিষ্কার বাতাসে শ্বাস নিয়ে
ফুসফুস পরিষ্কার করতে প্রাতঃভ্রমণ তাঁর নিত্যকর্ম। এখনও তার চুল পাকেনি। দাঁত পড়েনি, চামড়া কোচকায়নি। পঁচাশি বছরেও দিব্যি সুঠাম চেহারা অম্বিকাঁচরণের। তবে কিনা লোকটা একটু বাতিকগ্রস্ত। তাঁর কাছে সবকিছুই সেই আগের মতোই আছে, কিছুই পাল্টায়নি।
এই যে বরদাচরণ এখন পূর্ণযুবক, ইয়া দশাসই লম্বা-চওড়া চেহারা, তার ওপর নামকরা গোয়েন্দা, এসব অম্বিকাঁচরণের খেয়ালেই থাকে না। সকালে উঠেই তিনি দাঁতন করে, পুজোপাঠ সেরে থানকুনিপাতা আর কলি-ওঠা ছোলা খেয়ে হাঁক দেন, “দাদুভাই ও দাদুভাই।” ডাক শুনে মনে হয় যেন তিন-চার বছর বয়সী নাতিকে ডাকছেন। সেই ডাক শুনে বরদাচরণ গুটিগুটি দাদুর কাছে এসে দাঁড়ান। তারপর দাদুর হাত ধরে পিছু পিছু বেরিয়ে আসেন। দাদু অম্বিকাঁচরণ যেভাবে বহুকাল আগে ছোট বরদাচরণকে সাবধানে নর্দমা পার করাতেন, এখনও তেমনি হাত ধরে নদৰ্মা পার করে দেন। গাড়িঘোড়া দেখলে বলেন, “সরে এসো দাদুভাই, চাপা দেবে যে!” কুকুর বা গোরু দেখলে হাঁ হাঁ করে ওঠেন, হাতের লাঠিটা আপসাতে আপসাতে বলেন, “যাঃ যাঃ, দাদুভাই ভয় পেয়ে কাঁদবে!”
বরদাচরণ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। কী আর করবেন! পরশুদিনও তিনি একজন ডাকাতকে ধরতে চলন্ত ট্রেন থেকে লাফিয়ে নেমেছেন। গত মাসেই তিনি খুনী রঘুবীর সিংয়ের পিস্তলের মুখে পড়েছিলেন। এই তত সেদিন কুখ্যাত একদল হাইজ্যাকারের পিছু নিয়ে ইণ্ডিয়ান এয়ারলাইনসের এক বোয়িং সাতশো সাঁইত্রিশ বিমানের একেবারে কেবিনের মধ্যে দুর্দান্ত ফাঁইট করে চারজন বিমান-ছিনতাইকারীকেই ঘায়েল করে এলেন। কিন্তু দাদুকে সে-কথা কে বোঝাবে?
দাদুর সঙ্গে বরদাচরণের এই মর্নিংওয়াক দেখে সবাই ভারী অবাক হয়।
হঠাৎই একদিন একখানা ঘটনা ঘটল। যাকে বলা যায় বাঘের ঘরে ঘোগের বাসা। প্রায় ষাট বছর আগে মুর্শিদাবাদের এক নবাবের বাড়িতে বিখ্যাত পাঞ্জাবী কুস্তিগীর শের সিংকে অম্বিকাঁচরণ হারিয়ে দেন। তাই নিয়ে খুব হৈ-চৈ হয়েছিল। নবাব খুশি হয়ে সোনায় বাঁধানো একখানা কাপ উপহার দিয়েছিলেন অম্বিকাঁচরণকে। এখনকার বাজারে সেই কাপটার দাম হেসেখেলে বিশ-পঁচিশ হাজার টাকা তো হবেই। অম্বিকাঁচরণ একখানা কাঁচের বাক্সে যত্ন করে কাপটা রেখে দিয়েছিলেন। নিজ হাতে রোজ মোছেন, কেউ এলে দেখান। হঠাৎ একদিন দেখা গেল, কাপটা নেই। তার বদলে কাঁচের বাক্সে একটা চিরকুট পড়ে আছে। তাতে লেখা : “অম্বিকাভাই, লড়াইটায় জোচ্চুরি ছিল। তুমি আমাকে চিত করতে পারেনি। আমার কোমরটা মাটিতে লেগেছিল মাত্র। কিন্তু নবাবের ব্যাপার্টি তখন এমন জগঝম্প বাজনা শুরু করে দিল আর তাই শুনে তুমি জিতেছ ভেবে সব মেয়ে-বউরা এমন শাঁখ বাজাতে আর উলু দিতে লাগল যে, আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। ওরকম আওয়াজ আমি জীবনে শুনিনি। তোমাকে কাঁধে নিয়ে লোকের সে কী নাচ! আমি নবাবকে অনেকবার বোঝানোর চেষ্টা করেছিলাম যে, লড়াইটা এখনও শেষ হয়নি, কিন্তু কে কার কথা শোনে? নবাব আমাকে আমলই দিলেন না। সেই থেকে মনের মধ্যে আগুন পুষে রেখেছি। ইচ্ছে ছিল তোমাকে অনেক আগেই হারিয়ে দিয়ে প্রমাণ করি যে, তোমার চেয়ে আমি অনেক বড় কুস্তিগীর। কিন্তু সেই সুযোগ আর এতকালের মধ্যে ঘটে ওঠেনি। নানা ধান্ধায় আমাকে দেশ বিদেশে ঘুরে বেড়াতে হয়েছে। তবে সর্বদাই আমি তোমার খোঁজখবর রেখেছি। এতদিন বাদে ফের তোমার পাত্তা মিলেছে। তোমার সঙ্গে দেখা করতে এসে তোমাকে পেলাম না। দেখলাম, সেই ট্রফিটা তোমার ঘরে আজও সাজানো আছে। দেখে পুরোনো স্মৃতিটা চাগিয়ে উঠল। রক্ত গরম হয়ে গেল, হাত পা নিশপিশ করতে লাগল। সামনে তোমাকে পেলে রদ্দা লাগাতাম। যাই হোক, এই ট্রফিটা আমি আমার বলেই মনে করি। তাই এটা চুপিচুপি নিয়ে যাচ্ছি। এতে যদি তোমার আপত্তি থাকে, তবে আগামীকাল বেলা বারোটার মধ্যে জেমিনি হোটেলের বারো নম্বর ঘরে এসো। ট্রফিটি যদি নিতান্তই ফেরত পেতে চাও, তাহলে আমার সঙ্গে আর-একবার তোমাকে কুস্তি লড়তে হবে। যদি তুমি জেতো, তাহলে তোমাকে ট্রফি তো ফেরত দেবই, ওস্তাদ বলেও মেনে নেব। আর যদি তুমি হারো, তাহলে আমাকে ওস্তাদ বলে সেলাম জানাবে। ইতি শের সিং।”