–ফ্রান্সিস। চাপাস্বরে কে ডাকল। ফ্রান্সিস দ্রুত ঘুরে তাকাল। ফজল! ফজল ওর তরোয়ালটা এগিয়ে দিল। তরোয়ালটা হাতে পেয়েই ফ্রান্সিস কাসেমের প্রথম আঘাতটা সামলাল। কাসেম আবার তরোয়াল তুলল। ঠিক তখনই সর্দারের বজ্রনির্ঘোষ কণ্ঠস্বর শোনা গেল–কাসেম ভুলে যেও না, আমরা লুঠ করতে এসেছি।
কাসেম উদ্যত তরবারি নামাল। শিকার হাত ছাড়া হয়ে গেল। দুজনে কি কথা হল। কাসেম তরোয়াল উঁচিয়ে ক্যারাভ্যানের দিকে ইঙ্গিত করল। কি হয় দেখবার জন্যে মরুদস্যুরা এতক্ষণ চুপ করে অপেক্ষা করছিল। সেই স্তব্ধতা খান খান হয়ে ভেঙে গেল তাদের চীৎকার। সবাই চীৎকার করতে করতে ছুটল ক্যারাভ্যানের দিকে। তারপর পৈশাচিক উল্লাসে ওরা ঝাঁপিয়ে পড়ল ক্যারাভ্যানের ওপর। আবার আর্তচীৎকার কান্নার রোল উঠল। অবাধ লুঠতরাজ চলল।
এবার ফেরার পালা। ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত মৃতদেহগুলোর ওপর দিয়েই দস্যুর দল ঘোড়া ছোটাল। ফ্রান্সিস অতটা অমানুষ হতে পারল না। অন্য দিক দিয়ে ঘুরে যেতে লাগল। হঠাৎ দেখল সেই ছেলেটি মাটিতে হাঁটু গেড়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। ফ্রান্সিস একবার ভাবল নেমে গিয়ে ওকে সান্ত্বনা দেয়। কিন্তু উপায় নেই। মরুদস্যর দল অনেকটা এগিয়ে গেছে। ফ্রান্সিস ঘোড়া ছুটিয়ে দলের সঙ্গে এসে মিশল। ওরা যখন সেই মরুদ্যানে ফিরে–এল তখন সূর্য মাথার ওপরে। চারদিকে বালির ওপর দিয়ে আগুনের হল্কা ছুটছে যেন।
বিকেলে খেজুর গাছটার তলায় ফজলের সঙ্গে দেখা হল। ফজল বললো
–অতগুলো লোকের প্রাণ বাঁচালে তুমি ভাই।
–কেন?
–তোমার কাছে বাধা পেয়েই তো কাসেম আর এগোতে সাহস করেনি।
–তা না হলে কি করতো?
–সব ক’জনকে মেরে ফেলতো।
–সে কি! মেয়েরা বাচ্চাগুলো–ওরা তো নিরপরাধ।
–কাসেমের নিষ্ঠুরতার পরিমাণ করতে পারবে না। জাহান্মামেও ওর ঠাঁই হবে না।
–হুঁ।
–ও কিন্তু তোমাকে সহজে ছাড়বে না। সাবধানে থেকো।
–ও আমার কি করবে?
–জানো না তো ভাই, দলের কেউ ওকে ঘাঁটাতে সাহস করে না, এমন কি সর্দারও না। হঠাৎ পেছনে কাকে দেখে ফজল থেমে গেল। কাসেম নয়। দস্যু দলের একজন। কাছে এসে ফ্রান্সিসকে ডাকল–এই ভিনদেশী–তোমাকে সর্দার এত্তেলা পাঠিয়েছেন।
–চলো, ফ্রান্সিস উঠে দাঁড়াল। তারপর লোকটার সঙ্গে তাঁবুর দিকে চলল।
একটা মোটা তাকিয়া ঠেস দিয়ে আধশোয়া অবস্থায় সর্দার রূপোর গড়গড়ায় তামাক খাচ্ছিল। ফ্রান্সিস গিয়ে দাঁড়াতে নল থেকে মুখ না তুলে ইঙ্গিতে তাকে বসতে বললো। জাজিমপাতা ফরাসের ওপর বসতে গিয়ে ফ্রান্সিস দেখল, কাসেমও একপাশে বসে আছে। কাসেম তীব্র দৃষ্টিতে ফ্রান্সিসের দিকে একবার তাকাল। পরক্ষণেই যেন প্রচণ্ড ঘৃণায় মুখ ঘুরিয়ে নিল। এতক্ষণে সর্দার কেশে নিয়ে ডাকল–ফ্রান্সিস।
–বলুন।
–তুমি বিদেশী–আমাদের রাজনীতি তোমার জানবার কথা নয়। তুমি আজকে যা করেছ, অন্য কেউ হলে তাকে এতক্ষণে বালিতে পুঁতে ফেলা হত।
ফ্রান্সিস চুপ করে রইল। সর্দার বললো কাশেম তুমি ওর সঙ্গে লড়তে রাজি আছ?
কাসেম সঙ্গে সঙ্গে খাপ থেকে একটানে তরবারিটা বের করে বললো–এক্ষুণি।
সর্দার ফ্রান্সিসের দিকে তাকাল–তুমি?
ফ্রান্সিস উঠে দাঁড়িয়ে বলল–আমি রাজী।
–হুঁ। সর্দার গড়গড়ার নলটা মুখে দিল। কয়েকবার টানল। তারপর বলল–রাত্তিরে তোমাকে ডেকে পাঠানো হবে। তৈরী হয়ে আসবে।
* * *
বালিতে কয়েকটা মশাল পুঁতে রাখা হয়েছে। চারদিকে ভীড় করে দাঁড়িয়েছে মরুদস্যু দলের লোকেরা। পরিষ্কার আকাশে লক্ষ তারার ভিড়। অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে বালিতে ফুটফুটে চাঁদের আলো।
ফ্রান্সিসকে আসতে দেখে মরু-দস্যুদলের ভিড়ের মধ্যে গুঞ্জন উঠল। ওরা ভিড় সরিয়ে পথ করে দিল। ফ্রান্সিস সহজ ভঙ্গিতে ভিড়ের মাঝখানকার ফাঁকা জায়গাটায় এসে দাঁড়াল। একদিকে সামিয়ানা টাঙানো হয়েছে, তার নিচে সর্দার বসে আছে। সেদিকে দাঁড়িয়ে আছে, কাসেম। হাতে খোলা তরোয়ালে মশালের আলো পড়ে চকচক করছে। মশালের আলো কাঁপছে তার টকটকে লাল আলখাল্লায়। ওকে দেখতে আরো বীভৎস লাগছে। ফ্রান্সিস তখনও খাপ থেকে তরোয়াল খোলেনি।
ফজলকে ডেকে সর্দার কি যেন বলল। ফজল কাসেমকে ফাঁকা জায়গার মাঝখানে এগিয়ে আসতে বলল। ফ্রান্সিসকেও ডাকল। ফ্রান্সিস এবার তরোয়াল খুলল। তারপর পায়ে-পায়ে এগিয়ে কাসেমের মুখোমুখি দাঁড়াল। সর্দার হাততালি দিয়ে কি একটা ইঙ্গিত করতেই কাসেম মুখোমুখি দাঁড়াল। সর্দার হাততালি দিয়ে কি একটা ইঙ্গিত করতেই কাসেম তরোয়াল উঁচিয়ে ফ্রান্সিসের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। ফ্রান্সিস এই অতর্কিত আক্রমণে প্রথমে হকচকিয়ে গেল। কাসেমের তরোয়ালের আঘাত ঠেকাল বটে, কিন্তু টাল সামলাতে না পেরে বালির ওপর বসে পড়ল। ভিড়ের কাসেম তরোয়াল উঁচিয়ে মধ্যে থেকে হাসির হররা উঠল। আবার কাসেম তরোয়াল ফ্রান্সিসের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। চালাল। এবারও একই ভঙ্গীতে ফ্রান্সিস কাসেমের তরোয়ালের ঘা থেকে আত্মরক্ষা করল। তারপর নিজেই এগিয়ে গিয়ে কাসেমকে লক্ষ্য করে তরোয়াল চালাল। শুরু হল দুজনের লড়াই। বিদ্যুৎগতিতেই দু’জনের তরোয়াল ঘুরছে। মশালের কাঁপা কাঁপা আলোয় চকচক করছে তরোয়ালের ফলা। ঠং-ঠং ধাতব শব্দ উঠছে তরোয়ালের ঠোকাঠুকিতে।
রুদ্ধ নিঃশ্বাসে মরুদস্যুর দল দেখতে লাগল এই তরোয়ালের লড়াই। কেউ কম যায় না। দুজনেরই ঘন-ঘন শ্বাস পড়তে লাগল। কপালে ঘামের রেখা ফুটে উঠল। হঠাৎ ফ্রান্সিসের একটা প্রচণ্ড আঘাত সামলাতে না পেরে বালিতে কাসেমের পা সরে গেল। কাসেম কাত হয়ে পড়ল। ফ্রান্সিস এই সুযোগ ছাড়ল না। দেহের সমস্ত শক্তি দিয়ে তরোয়াল চালাল। কাসেম মরীয়া হয়ে সে আঘাত ফেরাল। কিন্তু মুঠি আলগা হয়ে তরোয়াল ছিটকে পড়ল একটু দূরে। কাসেম চিৎহয়ে বালিতে পড়ে গেল, ফ্রান্সিস তরোয়াল নামিয়ে কাসেমের দিকে তাকাল। কাসেমের চোখেমৃত্যুভীতি। মুখ হাঁকরে সেশ্বাস নিচ্ছে তখন। ফ্রান্সিসও হাঁপাচ্ছে। ফ্রান্সিস তরোয়ালের ছুঁচলো ডগাটা। কাসেমের লাল আলখাল্লায় বিঁধিয়ে একটা টান দিল। লাল আলখাল্লাটা দু’ফালি হয়ে গেল। বুকের অনেকটা জায়গা কেটেও গেল, রক্তে ভিজে উঠল আলখাল্লাটা। মরুদস্যুদের মধ্যে গুঞ্জনধ্বনি উঠল। কোনদিকে না তাকিয়ে ফ্রান্সিস চলল সর্দারের কাছে। ও তো জানে এক রকম দু’জনের মধ্যে তরোয়ালের লড়াইয়ের ক্ষেত্রে বেদুইনদের রীতি কী? সর্দার যা বলবে তাই সে করবে।