–খিদে পেয়েছে নিশ্চয়ই।
–হ্যাঁ।
লোকটা দ্রুতপায়ে তাবুর বাইরে চলে গেল। ফ্রান্সিস বুঝল–এই লোকটাই তার সেবাশুশ্রূষার ভার নিয়েছে।
পরের দিন বিকেল পর্যন্ত ফ্রান্সিস প্রায় সমস্তক্ষণ বিছানায় শুয়ে রইল। কপালকাটা লোকটাই তার দেখাশুনা করল। ফ্রান্সিস ঐ লোকটার কাছ থেকে শুধু এইটুকুই জানতে পারল, যে এরা একদল বেদুইন ব্যবসায়ী। এখান থেকে কিছুদূরেই আমদাদ শহর। এখানকার সুলতানের রাজধানী। ওখানেই যাবে এরা। সারাদিন এদের দলপতি বারদুয়েক ফ্রান্সিসকে দেখে গেছে। দলপতির দীর্ঘ দেহ, পরনে আরবীয় পোশাক, কোমরে সোনার কাজকরা খাপে লম্বা তরোয়াল। দলপতি বেশ হেসেই কথা বলছিল ফ্রান্সিসের সঙ্গে। ফ্রান্সিসকে তার যে বেশ পছন্দ হয়েছে, এটা বোঝা গেল। দলপতির সঙ্গে সবসময়ই একটা লোককে দেখছিলই বোঝা যায় লোকটা নিষ্ঠুর প্রকৃতির।
তখন সূর্য ডুবে গেছে। অন্ধকার হয়ে আসছে চারদিক। ফ্রান্সিস তাঁবু থেকে বেরিয়ে একটা, খেজুর গাছের নীচে এসে বসল। জলাশয়ের ওপর একজন বেদুইন একা তেড়াবাঁকা তারের যন্ত্র বাজিয়ে নাকিসুরে গান করছে। ফ্রান্সিস চুপ করে বসে গান শুনতে লাগল। হঠাৎফ্রান্সিস দেখল দূরে ছায়া-ছায়া বালি-প্রান্তর দিয়ে কে যেন খুব জোরে ঘোড়াছুটিয়ে আসছে। লোকটা এল। তারপর ঘোড়া থেকে নেমেই সোজা দলপতির আঁবুতে ঢুকে পড়ল। একটু পরেই দলপতির তাঁবু থেকে কয়েকজনকে বেরিয়ে আসতে দেখা গেল। কয়েকজন ঢুকল। বেশ একটা ব্যস্ততার ভাব। কিখবর নিয়ে এল লোকা? ফ্রান্সিসের হঠাৎ মনে হল, ওরপাশেই কে যেন এসে দাঁড়িয়েছে। আরে? সেই কপাল কাটা লোকটা। ওর জন্যে অনেক করেছে অথচনাম জানা হয়নি।
–আরে বসো-বসো। ফ্রান্সিস সরে বসবার জায়গা করে নিল। লোকটাও বসল।
–কি কাণ্ড দেখ–তোমার নামটাই জানা হয় নি। ফ্রান্সিস বলল।
–ফজল আলি, সবাই ফজল বলেই ডাকে–লোকটা আস্তে-আস্তে বলল।
এবার কি জিজ্ঞেস করবে ফ্রান্সিস ভেবে পেল না।
ফজলই কথা বলল–তুমি আমার কপালের দাগটার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়েছিলে।
ফ্রান্সিস একটু অপ্রস্তুত হল। বলল–তা ওরকম দাগ তো বড় একটা দেখা যায় না।
–আমার ভাই তরোয়াল চালিয়েছিল। এটা তারই দাগ।
–সে কি!
–হ্যাঁ।
ফ্রান্সিস চুপ করে রইল।
–সেইদিন থেকে তরোয়াল একটা রাখতে হয় তাইরাখি, কিন্তু আজ পর্যন্ত সেটা খাপ থেকে বের করিনি। যাকগে ফজল একটু থেমে বলল–তুমি তো ভাই এখানকার লোক নও।
–ঠিক ধরেছো–আমি ভাইকিং।
–ভাইকিং! বাপরে, তোমাদের বীরত্বের অনেক কাহিনী আমরা শুনেছি।
–তাই নাকি? ফ্রান্সিস হাসল।
–তোমার নাম?
–ফ্রান্সিস।
–কোথায় যাচ্ছিলে?
ফান্সিস একটু ভাবল। সোনার ঘন্টার খোঁজে যাচ্ছিলাম, এ সব বলা বিপজ্জনক। তা ছাড়া ও সব বললে পাগলও ঠাউরে নিতে পারে। বলল—এই–ব্যবসায় ফিকিরে–
–জাহাজ ডুবি হয়েছিল?
–হ্যাঁ।
দু’জনের কেউ আর কোন কথা বলল না। ফ্রান্সিস একবার আকাশের দিকে তাকাল। পরিষ্কার আকাশজুড়ে তারা। কি সুন্দর লাগছে দেখতে। হঠাৎ ফজল চাপাস্বরে ডাকল–ফ্রান্সিস?
–কি?
–যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই দল ছেড়ে পালাও।
ফ্রান্সিস চমকে উঠে বললো–কেন?
ফজল চারিদিকে তাকিয়ে চাপাস্বরে বলল–এটা হচ্ছে বেদুইন মরুদস্যুদের দল।
–সে কি!
–হ্যাঁ।
–তুমিও তো এই দলেরই।
–উপায় নেই ভাই–একবার এই দস্যুদলে ঢুকলে পালিয়ে যাওয়ার সব পথ বন্ধ।
–কেন?
–এই তল্লাটের সব শহরে, বাজারে, মরুদ্যানে এদের চর রয়েছে। তোমাকে ঠিক খুঁজে বার করবে। তারপর
–মানে–খুন করবে?
–বুঝতেই পারছো।
–কিন্তু–ফ্রান্সিসের সংশয় যেতে চায় না। বলল–সর্দারকে তো ভালো লোক বলেই মনে হল।
–তা ঠিক কিন্তু সর্দারকে চালায় কাসেম–কাসেমকে দেখেছ তো? সব সময় সর্দারের সঙ্গে থাকে।
–হ্যাঁ–বীভৎস দেখতে।
–যেমন চেহারা তেমনি স্বভাব। ওর মত সাংঘাতিক মানুষ আমি জীবনে দেখিনি।
–হুঁ। কাসেমকে দেখে আমারও তাই মনে হয়েছে।
–কালকেই দেখতে পাবে, কাসেমের নিষ্ঠুরতার নমুনা।
–তার মানে?
আজকে শেষ রাত্তিরে আমরা বেরুবো। গুপ্তচর খবর নিয়ে এসেছে এইমাত্র–মস্তবড় একটা ক্যারাভান (মরুপথের যাত্রীদল) এখান থেকে মাইল পাঁচেক দূর দিয়ে যাবে।
–ক্যারাভ্যান?
–হ্যাঁ। ব্যবসায়ীদের ক্যারাভ্যান। দামী-দামী মালপত্র নিয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া মোহর, সোনার গয়নাগাঁটি এসব তো রয়েইছে। ক্যারাভ্যানে তো শুধু ব্যবসায়ীরাই যায় না অন্য লোকেরাও যায় তাদের পরিবারের লোকজন নিয়ে। দল বেঁধে গেলে ভয় কম।
–তোমরা ক্যারাভ্যান লুঠ করবে?
–সর্দারের হুকুম। কথাটা বলেই ফজল গলা চড়িয়ে অন্য কথা বলতে শুরু করল–শুনেছি তোমাদের দেশে নাকি বরফ পড়ে–আমরা বরফ কোনদিন চোখেও দেখিনি। ফ্রান্সিস কি বলবে বুঝে উঠতে পারল না। তবে অনুমান করলো কাউকে দেখেই ফজল অন্য কথা বলতে শুরু করেছে। আড়চোখে তাকিয়ে দেখল খেজুর গাছের আড়াল থেকে কে যেন বেরিয়ে এল। কাসেম! কাসেম গম্ভীর গলায় বলল ফজল, শেষ রাত্তিরে বেরুতে হবে-ঘুমিয়েনাও গে যাও।
–হ্যাঁ এই যাচ্ছি। ফজল তাড়াতাড়ি উঠে পড়ল। চলে যেতে-যেতে গলা চড়িয়ে বলল–তাহলে ঐ কথাই রইল–তুমি ওখান থেকে বরফ চালান দেবে, বদলে আমি এখান থেকে বালি চালান দেবো।
কাসেম এবার কুৎসিত মুখে হাসলো–এই সাদা ভিনদেশী–তুইও যাবি সঙ্গে।