ফান্সিসের সেই রুদ্রমূর্তি দেখে সবাই বেশ ঘাবড়ে গেল! ওরা জানতো–ফ্রান্সিস জাতিতে ভাইকিং। তরোয়াল হাতে থাকলে ওদের সঙ্গে এঁটে ওটা মুশকিল। ডেক-এর ওপরে এত হই-চই চীৎকার ছুটোছুটির শব্দে মালিক আর নাবিকসর্দার ওপরে উঠে এল। ওরা ভাবতেই পারেনি, যে ব্যাপার এতদূর গড়িয়েছে। এদিকে দু’জন ডেক-এর ওপর রক্তাক্ত দেহে কাতরাচ্ছে–ওদিকে ফ্রান্সিস খোলা তরোয়াল হাতে রুদ্রভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে।
জাহাজের মালিক আশ্চর্য হয়ে গেল। সে দু’হাত তুলে চীৎকার করে বলল–শোন সবাই–মারামারি করবার সময় পরে অনেক পাবে, এখন যে বিপদে পড়েছি, তা থেকে উদ্ধারের কথা ভাবো।
এতক্ষণ উত্তেজনা মারামারির মধ্যে সবাই বিপদের কথা ভুলে গিয়েছিল। এখন আবার সবাই ভয়-ভয় চোখে চারদিকে ঘন কুয়াশার দিকে তাকাতে লাগল। কারো মুখে কথা নেই। এমন সময় ষণ্ডাগোছের নাবিকদের মধ্যে একজন চীৎকার করে বলল–এই যে জ্যাকব-–ও ইহুদী ওর জন্যই আমাদের এই বিপদ।
আবার গোলমাল শুরু হল। মালিক দু’হাত তুলে সবাইকে থামাবার চেষ্টা করতে লাগল। গোলমাল কর্মূলে বলল–এটা বাপু জাহাজ–গীর্জে নয়! কার কি ধমমো, তাই দিয়ে আমার কি দরকার। আমি চাই কাজের লোক। জ্যাকব তো কাজকর্ম ভালোই করে।
আবার চীৎকার শুরু হল–আমরা ওসব শুনতে চাই না।
–জ্যাকবকে জাহাজ থেকে ফেলে দাও।
–ফাঁসিতে লটকাও।
জাহাজের মালিক ব্যবসায়ী মানুষ। সে কেন একটা লোকের জন্যে ঝামেলা পোহাবে। সে বলল–বেশ তোমরা যা চাইছ, তাই হবে।
ফ্রান্সিস চীৎকার করে বলে উঠল–আমার হাতে তরোয়াল থাকতে সেটি হবে না।
জাহাজের মালিক পড়ল মহাফাঁপরে! তবে সে বুদ্ধিমান ব্যবসায়ী। খুনোখুনি-রক্তপাত এসবে বড় ভয়। বলল–ঠিক আছে, আর একটা দিন সময় দাও তোমরা। দাঁড়ে হাত লাগাও–জাহাজ চলুক দেখা যাক–যদি একদিনের মধ্যেও কুয়াশা না কাটে তাহলে জ্যাকবকে ছুঁড়ে ফেলে দিও।
নাবিকদের মধ্যে গুঞ্জন চলল। একটু পরে সেই ষণ্ডাগোছের নাবিকটা বলল, ঠিক আছে–আমরা আপনাকে একদিন সময় দিলাম।
–তাহলে আর দেরি করো না। সবাই যে যার কাজে লেগে পড়ো। মালিক নাবিক সর্দারের দিকে ইশারা করল। সর্দার ফ্রান্সিসের কাছে গিয়ে হাত বাড়িয়ে দাঁড়াল। ফ্রান্সিস একবার সেই নাবিকদের জটলার দিকে তাকাল। তারপর তরোয়ালটা সর্দারের হাতে দিল। চাপাস্বরে জ্যাকবকে বলল–ভয় নেই। দেখো একদিনের মধ্যে অনেক কিছু ঘটে যাবে।
নাবিকদের জটলা ভেঙে গেল। যে যারকাজে লেগে পড়ল। একদল পাল সামলাতে মাস্তুল বেয়ে ওপরে উঠতে লাগল। ফ্রান্সিসদের দল সর্দারের নির্দেশে সবাই জাহাজের খোলে নেমে এল। সেখানে দু’ধারে সার সার বেঞ্চির মত কাঠের পাটাতন পাতা। সামনে একটা লম্বাদাড়ের হাতল। বেঞ্চিতে বসে ওরা পঞ্চাশজন দাঁড়ে হাত লাগাল। তারপর সর্দারের ইঙ্গিতে একসঙ্গে পঞ্চাশটা দাঁড় পড়ল জলে—ঝপ–ঝপ। জাহাজটা নড়েচড়ে চলতে শুরু করল। ফ্রান্সিসের, ঠিক সামনেই বসেছিল জ্যাকব। দাঁড় টানতে টানতে ফ্রান্সিস ডাকল–জ্যাকব?
–হুঁ।
–যদি সেই বুড়ো নাবিকটার কথা সত্যি হয়, তাহলে—
–তাহলে কী?
–তাহলে আর কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা ঝড়ের মুখে পড়ব।
–তারপর?
–ডুবো পাহাড়ে ধাক্কা লেগে—
–জলের তলায় অক্কা পাবে—
–তার আগে সোনার ঘন্টাটা বাজনা তো শুনতে পাবো।
জ্যাকব এবার মুখ ফিরিয়ে ফ্রান্সিসের মুখের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলল–
–পাগল!
জাহাজ চলল। ছপ-ছপ। পঞ্চাশটা দাঁড়ের শব্দ উঠছে। চারিদিকে জমে থাকা কুয়াশার মধ্য দিয়ে জাহাজ চলছে। কেমন একটা গুমোট গরম। দাঁড়িদের গা দিয়ে দরদর করে ঘাম ঝরছে। একফোঁটা হাওয়ার জন্যে সবাই হা-হুতাশ করছে।
হঠাৎ একটা প্রচণ্ড ঝড়ো হাওয়ার ঝাঁপটায় সমস্ত জাহাজটা ভীষণভাবে কেঁপে উঠল। কে কোথায় ছিটকে পড়ল, তার ঠিক নেই। পরক্ষণেই প্রবল বৃষ্টিধারা আর হাওয়ার উন্মত্ত মাতন। তালগাছসমান উঁচু-উঁচু ঢেউ জাহাজের গায়ে এসে আছড়ে পড়তে লাগল। জাহাজটা কলার মোচার মত ঢেউয়ের আঘাতে দুলতে লাগল। এই একবার জাহাজটা ঢেউ-এর গভীর ফাটলের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে, আবার পরক্ষণেই প্রচণ্ড ধাক্কায় উঠে আসছে ঢেউয়ের মাথায়।
ঝড়ের প্রথম ধাক্কায় ফ্রান্সিস মুখ থুবড়ে পড়েছিল। তবে সামনে নিয়েছিল খুব। কারণ ও তৈরীই ছিল–ঝড় আসবেই। আর সবাই এদিক-ওদিক ছিটকে পড়েছিল। হামাগুড়ি দিয়ে কাঠের পাটাতন ধরে ধরে অনেকেই নিজের জায়গায় ফিরে এল। এল না শুধু জ্যাকব। কিছুক্ষণ আগে যে ধকল গেছে ওর ওপর দিয়ে। তারপর ঝড়ের ধাক্কায় টাল সামলাতে না পেরে পাটাতনের কোণায় জোর ধাক্কা খেয়ে ও অজ্ঞানের মত পড়েছিল একপাশে। ফ্রান্সিস কয়েকবার জ্যাকব কেডাকল। ঝড়ের গো-গোয়ানি মধ্যে সেই ডাক-জ্যাকবের কানে পৌঁছল না। ফ্রান্সিস দাঁড় ছেড়ে হামাগুড়ি দিয়ে এদিক-ওদিক ঘুরে জ্যাকবকে খুঁজতে লাগল। কিন্তু কোথায় জ্যাকব? আর খোঁজা সম্ভব নয়। প্রচণ্ড দুলুনির মধ্যে টাল সামলাতে না পেরে বারবার হুমড়ি খেয়ে পড়ছিল ফ্রান্সিস।
হঠাৎ শক্ত কিছুতে ধাক্কা লেগে জাহাজের তলাটা মড়মড় করেউঠল। দাঁড়গুলো প্যাকাটির মত মটমট করে ভেঙে গেল। ফ্রান্সিস চমকে উঠল–ডুবোপাহাড়! আর এক মুহূর্ত দেরি না করে ফ্রান্সিস বহু কষ্টে টলতে টলতে ডেক-এর ওপর উঠে এল। দেখল, ঝোড়ো হাওয়ার আঘাতে বিরাট ঢেউ ডেক-এর ওপর আছড়ে পড়ছে। আর সে কি দুলুনি! ঠিক তখনই সমস্ত জল ঝড় বৃষ্টির শব্দ ছাপিয়ে শুনতে পেল ঘন্টার শব্দ–ঢং-ঢং-ঢং। ঘন্টা বেজেই চলল। সোনার ঘন্টার শব্দ–ঢং-ঢং।