–কেন?
–সবাই ভয়ে মরছি, আর তুমি কিনা শিস দিচ্ছো? ফ্রান্সিস হেসে উঠল। জ্যাকব মুখ বেঁকিয়ে বলল, তোমরা ভাইকিং–খুব সাহসী তোমরা, কিন্তু তাই বলে তোমার কি মৃত্যু ভয়ও নেই?
–আছে বৈকি! তবে আমার খুশী হবার অন্য কারণ আছে।
–বলো কি?
–হ্যাঁ। ফ্রান্সিস জ্যাকবের কানের কাছে মুখ দিয়ে চাপা খুশীর স্বরে বলতে লাগল জানো সেই বুড়ো পাগলা নাবিকটা বলেছিল–ওদের জাহাজ ঝড়ের মুখে পড়বার আগে ডুবো পাহাড়ে ধাক্কা খাওয়ার আগে–এমনি ঘন কুয়াশার মধ্যে আটকে গিয়েছিল ঠিক এমনি অবস্থা, বাতাস নেই, কুয়াশায় চারিদিক অন্ধকার ।
ফ্রান্সিস আর জ্যাকব ডেক-এর কোনায় দাঁড়িয়ে যখন কথা বলছিল, তখন লক্ষ্য করেনি যে, ডেক-এর আর এক কোনে নাবিকদের একটা জটলার সৃষ্টি হয়েছে। ওরা ফিসফিস্ করে নিজেদের মধ্যে কি যেন বলাবলি করছে। দু-একজন চোখের ইশারায় জ্যাকবকে দেখাল। ব্যাপারটা সুবিধে নয়। কিছু একটা ষড়যন্ত্র চলছে। জ্যাকব সজাগ হল। ফ্রান্সিস এতক্ষণ লক্ষ্য করেনি। ও উলটোদিকে মুখ ফিরিয়ে সামনের সাদাটে কুয়াশার আস্তরণের দিকে তাকিয়ে নিজের চিন্তায় বিভোর।
নাবিকদের জটলা থেকে তিন-চারজন ষণ্ডাগোছেরনাবিক ধীর পায়ে ওদের দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। জ্যাকব ওদের মুখ দেখেই বুঝলো, কিছু একটা কুমতলব আছে ওদের। ফ্রান্সিসকে কনুই দিয়ে একটা গুঁতো দিল। ফ্রান্সিস ঘুরে দাঁড়াল। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে জ্যাকবের দিকেতাকাল। জ্যাকব চোখের ইশারায় ষণ্ডাগোছের লোকগুলোকে দেখাল। তাদের পেছনে পেছনে আর সবনাবিকেরা দল বেঁধে এগিয়ে আসছে দেখা গেল। ফ্রান্সিস কিন্তু এই থমথমে আবহাওয়াটাকে কাটিয়ে দেবার জন্যে হেসে গলা চড়িয়ে বলল–ব্যাপার কি? আঁ–এখানে নাচের আসর বসবে নাকি? কিন্তু কেউ ওর কথার জবাব দিল না। ষণ্ডাগোছের লোক ক’জন ওদের দুজনের কাছ থেকে হাত পাঁচেক দূরে এসে দাঁড়াল। দলের মধ্যে থেকে ইয়া দশাসই চেহারার একজন গম্ভীর গলায় ডাকল–এই জ্যাকব, শোন্ এদিকে।
ফ্রান্সিস তখন হেসে বলল–যা বলবার বাপু ওখান থেকেই বলো না।
সেই নাবিকটা এবার আঙ্গুল দিয়ে জ্যাকবকে দেখিয়ে পেছনের নাবিকদের বলল এই জ্যাকব ব্যাটা ইহুদী। এই বিধর্মীটা যতক্ষণ জাহাজে থাকবে–ততক্ষণ কুয়াশা কাটবে না–বিপদ আরো বাড়বে! তোমরাই বলল ভাই এই অলুক্ষুণেটাকে কি করবো?
হই-হই চীৎকার উঠল নাবিকদের মধ্যে।
কেউ-কেউ তীক্ষ্মস্বরে চেঁচিয়ে বলল–জলে ছুঁড়ে ফেলে দাও।
–খুন কর বিধর্মীটাকে।
–ফাঁসীতে লটকাও।
ভয়ে জ্যাকবের মুখ সাদা হয়ে গেল। কিছু বলবার জন্য ওর ঠোঁট দুটো কাঁপতে লাগল। কিছুই বলতে পারল না। দুহাতে মুখ ঢেকে ও কেঁদে উঠল। দশাসই চেহারার নাবিকটা জ্যাকবের উপর ঝাঁপিয়ে পড়বার উপক্রম করতেই ফ্রান্সিস জ্যাকবকে আড়াল করে দাঁড়াল। ফ্রান্সিসের তখন অন্য চেহারা। মুখের হাসি মিলিয়ে গেছে। সমস্ত শরীরটা ইস্পাতের মত কঠিন হয়ে উঠেছে। চোখ জুজু করছে। দাঁতচাপা স্বরে ফ্রান্সিস বলল–জ্যাকব আমার বন্ধু। যে ওর গায়ে হাত দেবে, তার হাত আমি ভেঙ্গে দেব।
একমুহূর্তে গোলমাল হই-চই থেমে গেল। ষণ্ডা ক’জন থমকে দাঁড়াল। কে যেন চীৎকার করে উঠল–দু’টোকেই জলে ছুঁড়ে ফেলে দাও।
আবার চিৎকার, মারমার রব উঠল। ফ্রান্সিস আড়চোখে এদিক-ওদিক তাকাতে তাকাতে দেখল ডেক-এর কোণার দিকে একটা ভাঙা দাঁড়ের হাতলের অংশটা পড়ে আছে। চোখের নিমেষে সেটা কুড়িয়ে নিয়ে লাঠির মত বাগিয়ে ধরল। চেঁচিয়ে বলল–সাহস থাকে তো এক-একজন করে আয়।
দশাসই চেহারার লোকটা ফ্রান্সিসের দিকে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল। বিদ্যুৎগতিতে একধারে সরে গিয়ে ফ্রান্সিস হাতের ভাঙা দাঁড়টা চালাল ওর মাথা লক্ষ্য করে। লোকটার মুখ দিয়ে একটা শব্দ বেরল শুধু—অঁ-ক। তারপরই ডেকের ওপর সে মুখ থুবড়ে পড়ল। মাথাটা দুহাতে চেপে কাতরাতে লাগল। ওর আঙ্গুলের ফাঁক দিয়ে রক্ত গড়াতে লাগল। ঘটনার আকস্মিকতায় সবাই থমকে দাঁড়ালো। কিন্তু একমুহূর্ত। তারপরেই আর একটা ষণ্ডাগোছের লোক ঘুষি বাগিয়ে ফ্রান্সিসের দিকে তেড়ে এল। ফ্রান্সিস তৈরী হয়েই ছিল। ভাঙা দাঁড়টা সোজা লোকটার থুতনি লক্ষ্য করে চালাল। লোকটা বেমক্কা মার খেয়ে দু’হাত শূন্যে তুলে ডেক-এর পাটাতনের ওপর চিৎ হয়ে পড়ল। দাঁত ভাঙল কয়েকটা। মুখ দিয়ে রক্ত উঠল। মুখ চেপে ধরে লোকটা গোঙাতে লাগল। ফ্রান্সিস উত্তেজিত নাবিকদের জটলার দিকে চোখ রেখে চাপাস্বরে ডাকাল–জ্যাকব।
জ্যাকব এতক্ষণে সাহস ফিরে পেয়েছে। বুঝতে পেরেছে ফ্রান্সিসের মত রুখেনাদাঁড়াতে পারলে মরতে হবে। জ্যাকব চাপাস্বরে উত্তর দিল কী?
–ঐ যে ডেকঘরের দেয়ালে সর্দারের বেল্টসুন্ধুতরোয়ালটা ঝোলানো রয়েছে–ঐ দেখছো?
–হ্যাঁ।
–এক ছুটে গিয়ে নিয়ে এসো। ভয় নেই–একবার তরোয়ালটা হাতে পেলে সবকটাকে আমি একাই নিকেশ করতে পারবো–জলদি ছোট–
জ্যাকব পড়ি কি মরি ছুটল ডেক-ঘরের দেয়ালের দিকে। নাবিকদের দল কিছু বোঝবার আগেই ও দেওয়ালে ঝোলানো তরোয়ালটা খাপ থেকে খুলে নিল। এতক্ষণে নাবিকের দল ব্যাপারটা বুঝতে পারল। সবাই হইহই করে ছুটল জ্যাকবকে ধরতে। জ্যাকব ততক্ষণে তরোয়ালটা ছুঁড়ে দিয়েছে ফ্রান্সিসের দিকে। তরোয়ালটা ঝনাৎ করে এসে পড়ল ফ্রান্সিসের পায়ের কাছে। তরোয়ালটা তুলে নিয়েই ও ছুটল ভিড়ের দিকে। ততক্ষণে ক্রুদ্ধ নাবিকের দল জ্যাকবকে ঘিরে ধরেছে। কয়েকজন মিলে জ্যাকবকে ধরে ডেক-ঘরের কাঠের দেয়ালে ওর মাথা ঠুকিয়ে দিতে শুরু করেছে। কিন্তু খোলা তরোয়াল হাতে ফ্রান্সিসকে ছুটে আসতে দেখে ওরা জ্যাকবকে ছেড়ে দিয়ে এদিক-ওদিক ছুটে সরে গেল। ফ্রান্সিস সেই নাবিকদলের দিকে তলোয়ার উঁচিয়ে গলা চড়িয়ে বলল–জ্যাকব বিধর্মী হোক, আর যাই হোক–ও আমার বন্ধু। যদি তোদের প্রাণের মায়া থাকে জ্যাকবের গায়ে হাত দিবি না।