ফ্রান্সিস ছিল জাতিতে ভাইকিং। ইউরোপের পশ্চিম সমুদ্র পথে ভাইকিংদের দেশ। ভাইকিংদের অবশ্য বদনাম ছিল জলদস্যুর জাত বলে। শৌর্যে বীর্যে এবং জাহাজ চালনায় অসাধারণ নৈপুণ্যের জন্যে ইউরোপের সব জাতিই তাদের তারিফ করত। ফ্রান্সিস কিন্তু সাধারণ ঘরের ছেলে না। ভাইকিংদের রাজার মন্ত্রীর ছেলে বিদেশী জাহাজে যাচ্ছিল সাধারণ নাবিকদের কাজ নিয়ে নিজের পরিচয় গোপন করে। এটা জানত শুধু ভুঁড়িওলা জ্যাকব।
মুরগীর ঠ্যাং চিবুতে চিবুতে জ্যাকব ডাকল ফ্রান্সিস?
–তুমি বাপু দেশে ফিরে যাও।
–কেন?
–আমাদের এই দাঁড়বাওয়া, ডেক-মোছা-এসব কমমো তোমার জন্যে নয়।
ফ্রান্সিস একটু চুপ করে থেকে বলল–তোমার কথাটা মিথ্যে নয়। এত পরিশ্রমের কাজ আমি জীবনে করিনি। কিন্তু জানো তো আমরা ভাইকিং–যেকোনোরকম কষ্ট সহ্য করবার ক্ষমতা আমাদের জন্মগত। তাছাড়া–
–কি?
–ছেলেবেলা থেকে শুনে আসছি সেই সোনার ঘন্টার গল্প—
–ও। সেই ডাকাত পাদ্রীদের সোনার ঘন্টা? আরে ভাই ওটা গাঁজাখুরী গপ্পো।
–আমার কিন্তু তা মনে হয় না।
–তবে?
–আমার দৃঢ় বিশ্বাস ভূমধ্যসাগরের ধারে কাছে কোন দ্বীপে নিশ্চয়ই সেই সোনার ঘন্টা আছে।
–পাগল। জ্যাকব খুক খুক করে হেসে উঠল।
ফ্রান্সিস একবার চারিদিকে তাকিয়ে নিয়ে চাপাস্বরে বললো–জানো–দেশ ছাড়বার আগে একজন বুড়ো নাবিকের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। বুড়োটা বলত–ও নাকি সোনার ঘন্টার বাজনা শুনেছে।
-এ্যাঁ? বলল কি! জ্যাকব অবাক চোখে তাকাল।
–লোকে অবশ্য বুড়ো নাবিকটাকে পাগল বলে ক্ষেপাত। আমি কিন্তু মন দিয়ে ওর গল্প শুনেছিলাম।
–কি-গল্প?
–ভূমধ্যসাগর দিয়ে নাকি ওদের জাহাজ আসছিল একবার। সেই সময় এক প্রচণ্ড ঝড়ের মুখে ওরা দিক ভুল করে ফেলে। তারপর ডুবো পাহাড়ের গায়ে ধাক্কা লেগে ওদের জাহাজ ডুবে যায়। ডুবন্ত জাহাজ থেকে জলে ঝাঁপিয়ে পড়ার সময় ও একটা ঘন্টার শব্দ শুনেছিল–ঢং-ঢং। ঝড়জলের শব্দ ছাপিয়ে বেজেই চলেছিল–ঢং-ঢং।
জ্যাকবের খাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। সে হাঁ করে ফ্রান্সিসের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে তারপর জিজ্ঞেস করলে–সোনার ঘন্টার শব্দ?
–নিশ্চয়ই। ফ্রান্সিস মাথা ঝাঁকিয়ে বলল।
ভুঁড়িওয়ালা জ্যাকবের মুখ দিয়ে আর কথা সরলো না।
পরের দু’দিন জাহাজের নাবিকদের বেশ আনন্দেই কাটলো। পরিষ্কার ঝকঝকে আকাশ। জোর বাতাস। জাহাজের পালগুলো হাওয়ার তোড়ে বেলুনেরমত ফুলে উঠল। জাহাজ চলল তীরবেগে। দাঁড়টানার হাড়ভাঙ্গা খাটুনি থেকে নাবিকরা এইদুদিন রেহাই পেল। কিন্তু জাহাজের ডেক পরিষ্কার করা, জাহাজের মালিকের ফাইফরমাস খাটা, এসব করতে হল। তবু নাবিকেরা সময় পেল–তাস খেলল, ছক্কা-পাঞ্জা খেলল, আজ্ঞা দিল, গল্পগুজব করল অনেক রাত পর্যন্ত।
ফ্রান্সিস যতক্ষণ সময় পেয়েছে হয় ডেক-এ পায়চারি করেছে, নয়তো নিজের বিছানায় শুয়ে থেকেছে। ভুঁড়িওলা জ্যাকব মাঝে-মাঝে ওর খোঁজ করে গেছে। শরীর ভালো আছে কিনা, জিজ্ঞেস করেছে। একটু খোশগল্পও করতে চেয়েছে। কিন্তু ফ্রান্সিসের তরফ থেকে কোন উৎসাহ না পেয়ে অন্য নাবিকদের আড্ডায় গিয়ে গল্প জুড়েছে। ফ্রান্সিসের একা থাকতে ভালো লাগছিল, নিজের চিন্তায় ডুবে থাকতে। দেশ ছেড়েছে কতদিন হয়ে গেল। আত্মীয়স্বজন সবাইকে ছেড়ে এক নিরুদ্দেশ যাত্রায় বেরিয়েছে ও। কবে ফিরবে অথবা কোনদিন ফিরবে কি না কে জানে। মাথায় ওর মাত্র একটাই সংকল্প, যে করেই হোক খুঁজে বের করতে হবে সোনার ঘন্টার হদিস।
সোনার ঘন্টার কথা ভাবতে-ভাবতে কখন ঘুমে চোখ জড়িয়ে এসেছিল, ফ্রান্সিস জানে না। হঠাৎ নাবিকদের দৌড়োদৌড়ি উচ্চ কণ্ঠে ডাকাডাকি-হাঁকাহাঁকি শুনে ওর ঘুম ভেঙে গেল। ভোর হয়ে গেছে বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু হল কি? এদের এত উত্তেজনার কারণ কি? এমন সময় জ্যাকব ছুটতে ছুটতে ফ্রান্সিসের কাছে এল।
–সাংঘাতিক কাণ্ড। জ্যাকব তখনও হাঁপাচ্ছে।
–কি হয়েছে?
–ওপরে–ডেক-এ চল–দেখবে’খন।
দ্রুতপায়ে ফ্রান্সিস ডেক-এর ওপরে উঠে এল। জাহাজের সবাই ডেক-এর ওপরে এসে জড়ো হয়েছে। ফ্রান্সিস জাহাজের চারপাশে সমুদ্র ও আকাশের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেল। প্রচন্ড গ্রীষ্মকাল তখন। আর বেলাও হয়েছে। অথচ চারদিকে কুয়াশার ঘন আস্তরণ। সূর্য ঢাকা পড়ে গেছে। চারদিকে কেমন একটা মেটে আলো। এক ফোঁটা বাতাস নেই। জাহাজটা স্থাণুর মত দাঁড়িয়ে আছে। সকলের মুখেই দুশ্চিন্তার ছাপ। এই অসময়ে কুয়াশা? কোন এক অমঙ্গলের চিহ্ন নয় তো?
জাহাজের মালিক সর্দার নাবিককে নিয়ে নিজের ঘরে চলে গেল। বোধহয় কি করবে এখন তারই শলা-পরামর্শ করতে। সবাই বিমূঢ়ের মত দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ ফ্রান্সিস খুশীতে শিস্ দিয়ে উঠল। আশ্চর্য! শিসের শব্দ অনেকের কানেই পৌঁছল। এই বিপত্তির সময় কোন বেআক্কেলে শিস দেয় রে? তারা ফ্রান্সিসের দিকে মুখ ফিরিয়ে তাকাল। দেখল–ফ্রান্সিসের মুখ মৃদু হাসি। এবার ওদের আরো অবাক হবার পালা। ফ্রান্সিসকেওরা কেউ কখনো হাসতে দেখেনি। সব সময় গোমড়া মুখে ভুরু কুঁচকে থাকতেই দেখেছে। মাথায় যেন রাজ্যের দুশ্চিন্তা। সেই লোকটা হাসছে? অবাক কাণ্ড!
ফ্রান্সিসের এই খুশীতে অর্থাৎ শিস দিয়ে ওঠাটা কেউ ভালো চোখে দেখল না। তবে সবাইমনে-মনে গজরাতে লাগল। জ্যাকব গম্ভীরমুখেফ্রান্সিসের কাছে এসে দাঁড়াল। চাপাস্বরে বলল–বেশী বাড়াবাড়ি করো না।