অনেক তথ্যই জানা গিয়েছিল ওর সম্বন্ধে। প্রতিবারই ক্যাশ লুঠ করার সময়ে হুমকি দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পিস্তল দুটো বার করে ফেলে ও। তারপর কোনও গাড়ির সাহায্য না নিয়েই চক্ষের নিমেষে অন্তর্হিত হয় নগদ সমেত। দারুণ চটপটে সে। দৌড়োতেও পারে হরিণের মতো অস্বাভাবিক দ্রুত বেগে। এবং যেখানেই তার আবির্ভাব হোক না কেন, রিভলভার দুটো সব সময়ে তার সঙ্গে থাকবেই। ভয় দেখাবার জন্যে পিস্তলের হ্যাঁমার ঠুকে ক্লিক ক্লিক্ শব্দ করাও তার আর একটা নিয়মিত নষ্টামি। বাঁধাধরা সূচি অনুসারেই কাজ চালিয়ে যায় কার্পেন্টার। দেখা গেছে, প্রতিদিন প্রায় পঁচিশ ডলার দরকার পড়ে ওর। উদাহরণ স্বরূপ, কোনও জায়গায় চড়াও হওয়ার পর যদি একশো ডলার হাতে পারে কার্পেন্টার, তাহলে অন্ততপক্ষে চারদিন আর কোনও উৎপাত করতে শোনা যায় না ওকে। আবার কখন-সখন যদি এর দ্বিগুণ অর্থ পকেটস্থ করতে পারে, তাহলে তো পুরো এক হপ্তা পায়ের ওপর পা তুলে দিয়ে জিরিয়ে নেয়। মদ্যশালায় তার আবির্ভাব ঘটে শুধু রাত্রে–দোকান বন্ধ করার সময়ে। কেননা, এই সময়ে ক্যাশে যত টাকা জমা পড়ে, তত টাকা সারা দিনে অন্য কোনও সময়ে পাওয়া সম্ভব নয়। কোনও কোনও পানাগারে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা সামনে বিয়ারের গেলাস নিয়ে ঝিমুতে থাকে ও। তারপর কাজ হাসিল করার পরেই গেলাসটি চুরমার করে দিয়ে যায় যাতে তার আঙুলের ছাপ গোয়েন্দাদের হাতে না পড়ে।
এইভাবে যাদের সিন্দুক ও হালকা করেছে তাদেরই একজনকে দিব্বি শান্তভাবে বলেছিল কার্পেন্টার–আরে মশাই নিজের মগজ খাটান। উত্তেজিত হবেন না, নাভার্সও হবেন না। দেখতেই তো পাচ্ছেন কীরকম স্থির আমি। আপনাকে পরলোক পাঠানোর কোনও সদিচ্ছাই নেই আমার। কাজেই আমার মতোই নির্বিকার থাকুন। তবে, বেচাল দেখলেই আপনার ওই আস্ত মগজে একটা ফুটো করে দিতে এতটুকুও দ্বিধা করব না। আর এক মদের দোকানের মালিকের কাছে শুনেছিলাম, কার্পেন্টার নাকি ক্যাশ থেকে তিনশো ডলার হাতিয়ে নিয়ে উধাও হওয়ার পরেও খদ্দেররা বিন্দুবিসর্গ টের পায়নি। পুলিশ আসবার পরে টনক নড়ে তাদের।
একবার ক্যাশ লুঠের পরেই একজন ট্যাক্সি-ড্রাইভারকে আশাহত করেছিল কার্পেন্টার। ড্রাইভারকে ও বুঝিয়ে-সুঝিয়ে বলে যে, একটা মারমুখো লোকের কাছ থেকে প্রাণ নিয়ে পালাতে চাইছে সে। স্ত্রীর শোবার ঘরে নাকি কার্পেন্টারকে দেখতে পেয়েছিল লোকটা। তাই তার রক্তদর্শন না করলে নাকি স্বামী ভদ্রলোক শান্ত হবে না। কাজে কাজেই যত তাড়াতাড়ি এ অঞ্চল থেকে সটকান দিতে পারে সে, ততই মঙ্গল। ড্রাইভার ভাবলে বুঝি সত্যি সত্যিই আরোহীর জীবনরক্ষা করছে সে। কিন্তু এত ঝক্কি পোহাবার পুরস্কার মিলল মাত্র দশ সেন্ট বখশিশ! নিজের পরিবার ছাড়া, প্রত্যেকের ক্ষেত্রেই এই একই রকম সঙ্কীর্ণমনা ছিল কার্পেন্টার। তাছাড়া, আরও একটা গুণ ছিল তার। বেশির ভাগ লুঠেরা খোলামকুচির মতো টাকা ছড়িয়ে দুদিনেই ফতুর হয়ে যায়। কিন্তু কার্পেন্টার ছিল বড় হিসেবী। অপচয় করা তার কোষ্ঠীতে লেখা ছিল না।
একবার খবর এল বেশ কয়েক মাস হল নর্থ ক্যারোনিলা অ্যাভিন্যুতে বোবা-কালাদের প্রতিষ্ঠান ক্র্যাকোভার হোম-এ আস্তানা নিয়েছে সে। জোর কানাঘুসো শুনলাম, এখানে গেলেই দর্শন মিলবে মহাপ্রভুর। বাড়িটা ঘেরাও করে ফেললাম আমরা। কিন্তু দেখা গেল দু-হপ্তা আগেই পাখি উড়েছে।
রাইটউড সরাইখানায় তার কুকীর্তির পর দু-মাস কেটে গেল। কিন্তু কোন গর্তে যে সে সেঁধিয়ে বসে রয়েছে, তার কোনও হদিশ পেলাম না আমরা। কার্পেন্টারের মার্জারের মতো ক্ষিপ্রতা আর তড়িৎ-তৎপরতায় প্রতিটি পুলিশকর্মী সজাগ হয়ে উঠেছিল। গায়ে এতটুকু আঁচ না লাগিয়ে পর-পর এতগুলি বে-আইনি কাজ করে সারা পুলিশবাহিনীকেই চ্যালেঞ্জ করে বসেছিল ও। শেষকালে সম্মেলনে বসলাম আমরা। নতুন কৌশল আর কর্মপদ্ধতির উদ্ভাবন করলাম। খুব সম্ভব মেয়েদের কাছ থেকেই পাওয়া যাবে তার বর্তমান ঠিকানা, এই আশায় এই ধরনের হেন মেয়ে নেই, যাদের জিজ্ঞাসাবাদ করতে ছাড়লাম আমরা। কিন্তু কার্পেন্টরের ছবি দেখা সত্ত্বেও কেউ চিনতে পারল না ওকে। শেষকালে বারমেড, সস্তা হোটেলের রিসেপশন ক্লার্ক, এবং অপরাধ দুনিয়ার ছিঁচকে চোর-ছ্যাচোড় থেকে শুরু করে রাঘব-বোয়ালদেরও রেহাই দিলাম না। কিন্তু বৃথাই। দেখা গেল, কার্পেন্টার বাস্তবিকই নির্বান্ধব। শিয়ালের মতো ধূর্ত সে। নিজের জীবিকা সমস্যার সমাধান করে সে নিজের বুদ্ধি-শক্তি দিয়েই–দুনিয়ার কারোর ওপর আস্থা নেই তার।
লোকটার সম্ভবপর গতিবিধি বিশ্লেষণ করার জন্যে হয়তো একজন মনোসমীক্ষকেরই দরকার ছিল আমাদের। অনেকবার এমন সম্ভাবনাও এসেছে আমাদের মাথায় যে হয়তো শহরতলীরই কোনও সম্মানজনক প্রতিষ্ঠানে দিনের বেলা ঘাপটি মেরে বসে রয়েছে সে। আর রাতের বেলা শ্রমিক হিসেবে কাজ করছে কোনও কারখানায় দিনের তৎপরতা গোপন করার জন্যেই। কিন্তু শিকাগো শহরটা তো আর ছোট শহর নয়। কাজেই এত সহজে এরকম চিরুনি-আঁচড়ানো তল্লাশি পর্ব পরিচালনা করা সম্ভব ছিল না কোনওমতেই।
কার্পেন্টারের জন্ম হয় ১৯২৯ সালে। অর্থনৈতিক নিস্তেজনার সেই সঙ্কটময় দিনগুলিতে শান্তি ছিল না পরিবারে। ঝগড়াঝাটি লেগেই ছিল বাবা আর মায়ের মধ্যে। শেষকালে বিবাহবিচ্ছেদ করে পৃথক হয়ে গেলেন ওর মা ছেলেমেয়েদের নিয়ে। আর, তার কিছুদিন পরেই মোটর দুর্ঘটনায় মারা গেলেন ওর বাবা। রিচার্ড কার্পেন্টারের বয়স তখন মাত্র দশ বছর। জীবন-বীমা না থাকায় দারুণ চাপ পড়ল ওর মায়ের ওপর। অভাব-অনটনের নিত্য নেই নেই হাহাকারে দেখতে দেখতে বুড়িয়ে গেলেন তার মা। তবুও ভেঙে পড়লেন না ভদ্রমহিলা। কষ্টেসৃষ্টে কোনওমতে শান্তি বজায় রাখলেন ছোট্ট পরিবারটির মধ্যে। রিচার্ড, তোর দুই বোন, আর নিজে–এই নিয়ে ছিল তার ছোট্ট সংসার। ছেলেমেয়েদের মধ্যে রিচার্ডকেই তিনি বেশি ভালোবাসতেন। তাছাড়া, আশ্চর্য একটা সম্প্রীতিবোধ ছিল তিন ভাইবোনের মধ্যে। এমন বড় একটা দেখা যায় না। রিচার্ড কিন্তু মা বলতে অজ্ঞান। মা ছাড়া তার এক দণ্ডও চলত না। মায়ের কোলে বসে আদর পাওয়ার মতো লোভনীয় জিনিস তার কাছে আর কিছুই ছিল না। একদিন এইভাবেই কোলে বসে মাকে জড়িয়ে ধরে হাউহাউ করে কেঁদে ফেলেছিল রিচার্ড। কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল–মা, নিজেকে বড় একা লাগছে আমার। আমাকে ছেড়ে যেও না। এরকম পরিস্থিতিতে সে যে মায়ের সবচেয়ে আদুরে হয়ে উঠবে, তা বলাই বাহুল্য।