দুটো বাজতে তখনও দশ মিনিট বাকি। দোকান বন্ধ করব করব ভাবছি, এমন সময়ে একটা লোক এসে হাজির। লোকটাকে আমি চিনিই না। ঠিক বন্ধের মুখে হুট করে আসার জন্যে মেজাজ খিঁচড়ে গেল আমার। তাই সাফ বলে দিলাম, চটপট এক ঢোক গিলেই বিদেয় হতে হবে। খদ্দের বেশি ছিল না তখন। কপোত-কপোতীর মতো একটি যুগল মূর্তি আর মের্ডাড বসাকি। মেডার্ড বসাকিকে তো আপনি চেনেনই। উনিও তো পুলিশ অফিসার। আজ রাতে ওঁর কোনও ডিউটি ছিল না।
লোকটাকে জিগ্যেস করলাম কী ধরনের সুরা তাকে দেব। কিন্তু আমার প্রশ্নের উত্তর-টুত্তর দিয়ে ফস করে এক জোড়া রিভলভার বার করে আমার দিকে তাগ করে ধরল সে। আর তার পরেই এক হুঙ্কার–টাকাগুলো বার করে দিলে কীরকম হয়?
শুনেই বসাতি হাত বাড়ালেন তাঁর রিভলভারের দিকে। লোকটা কিন্তু ভারী হুঁশিয়ার। সঙ্গে সঙ্গে যেন কিছু হয়নি এমনি সবে বলে উঠল–আপনি বরং ওটা টেবিলের ওপরেই রেখে দিন। তা না হলে আজ রাতেই একজনকে অক্কা পেতে হবে।
আমিই বললাম বসাকিকে–শুনুন শুনুন, রিভলভারটা সরিয়েই রাখুন। আমি চাই না খামোকা একটা খুনোখুনি হয়ে যাক এখানে। নগদ যত টাকা আছে তা না হয় ওকে দিয়ে দিচ্ছি আমি।
কথা শুনলেন বসাকি। গোঁয়ার্তুমি করলেন না। বাস্তবিকই, আমাকে অথবা অন্য কাউকে বিপদে ফেলার ইচ্ছে তো ওঁর ছিল না।
বন্দুকধারী এবার বসাকিকেই উদ্দেশ্য করে বললেন,–ভালো মানুষের মতো রিভলভারটা আমার দিকে ঠেলে এগিয়ে দিন দিকি মশাই। কথার সঙ্গে সঙ্গে ক্লিক করে শব্দ হল দুটো রিভলভারেরই।
প্রথম থেকেই লক্ষ্য করলাম লোকটা একেবারেই নিরুত্তেজ, নিরুদ্বেগ, আর সংহত। বসাকি রিভলভারটা বারের টেবিলের ওপর দিয়ে ঠেলে এগিয়ে দিলে পর নির্বিকারভাবে লোকটা তা তুলে নিয়ে গুঁজে রাখল পকেটে। তারপর আমাকে লক্ষ্য করে বললে–এবার স্মার্ট ছেলের মতো চটপট টাকা কড়িগুলো বার করে দিন তো। সবুজ রঙের যা কিছু নোট-ফোট আছে, তাই দিন। খুচরা নিয়ে মাথা ঘামাবেন না।
বাক্যব্যয় না করে কড়কড়ে ষাটটা ডলার তুলে দিলাম লোকটার হাতে। টাকাটা পকেটস্থ করেই এক দৌড়ে চোখের আড়াল হয়ে গেল সে।
বসাকি এরপর এক মুহূর্তের বেশি সবুর করেননি। কিন্তু আততায়ী তার চাইতে অনেক বেশি ক্ষিপ্র। কাজেই পথে বেরিয়ে লোকটার টিকিও দেখতে পাননি বসাকি। রাস্তায় শুধু তাল তাল অন্ধকারই ছিল না, ছিল অজস্র আঁকাবাঁকা সরু গলি। যে-কোনও একটার মধ্যে ঢুকে সটকান দেওয়া এমন কি আর কঠিন কাজ।
আমি আসার আগেই বেরিয়ে গিয়েছিলেন বসাকি। খুব শিগগিরই তাঁর সঙ্গে দেখা হওয়ার সম্ভাবনাও কম। তবুও বন্দুকধারী আগন্তুকের নিখুঁত দৈহিক বর্ণনা পেতে বিশেষ বেগ পেতে হল না আমাকে। লোকটা ধূমকেতুর মতো যখন ঢুকে পড়ে মদ্যশালায়, তখন যে তরুণ-তরুণী দুটি ছিল ঘরের মধ্যে, তাদের কাছ থেকে এবং চৌয়ানস্কির মুখে যা শুনলাম, তা থেকেই লোকটা স্পষ্ট হয়ে উঠল মনের চোখে। বয়সে সে যুবাপুরুষ, কালো-কালো এক মাথা চুল, ছিপছিপে চেহারা–দেখতে শুনতে মন্দ নয়। পরনে তার কালো প্যান্ট। খাটো হাতা স্পোর্টস শার্টটা প্যান্টের ওপর এমনভাবে ঝুলিয়ে দিয়েছিল সে যে বেল্টে গোঁজা রিভলভার দুটো তাইতেই ঢাকা পড়ে গিয়েছিল।
বসাকি আসার আগেই বেশ বুঝেছিলাম লোকটাকে। বসাকির কাছে পরে শুনলাম লোকটার চেহারার আর এক দফা বর্ণনা। আর এরকম হরিণের মতো দৌড়োতে নাকি তিনি এর আগে আর কাউকে দেখেননি। ঘাঁটিতে বসে এ সম্বন্ধে বেশ কিছুক্ষণ আলোচনা হল আমাদের মধ্যে। ১৯৫৫ সালের এপ্রিল ফুলের তারিখ দেওয়া আমার রিপোর্টটাও সঙ্গে ছিল। লেফটেন্যান্ট ফ্র্যাঙ্ক পেপে রিপোর্টটার ওপর একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে এক কথায় বলে দিলেন এ অপকর্ম কোনও মহাপ্রভুর।
বললেন–এ কাজ ওই বোম্বেটে কার্পেন্টার ছোকরার। এই নিয়ে সত্তরবার হল। কিন্তু ওকে আমি বার করবই। এই যদি আমার জীবনের শেষ গ্রেপ্তার হয়, তাহলেও জেনো, ওর রেহাই নেই।
বাস্তবিকই রেগে আগুন হয়ে গিয়েছিলেন ফ্র্যাঙ্ক পেপে। ঝানু অফিসার হিসেবে তার অভিজ্ঞতা তো বড় কম নয়। সহকর্মীরা তাঁকে যেমন ভালোবাসত, শ্রদ্ধা করত ঠিক তেমনি তাকে যমের মতো ভয়ও করত আর দু-চক্ষে দেখতে পারত না শিকাগোর অপরাধদুনিয়ার বাসিন্দারা। বেশ কয়েকবার গুলি-গোলা চলেছিল পুলিশ আর শহরের গুন্ডাদের মধ্যে। ফ্র্যাঙ্ক পেপে কিন্তু লড়াই-অন্তে এমন আটজন মূর্তিমানবকে শ্রীঘরে পাঠিয়েছিলেন, খুন-জখম আর ডাকাতির জন্যে যারা কুখ্যাত।
পেপের সঙ্গে কথাবার্তা, শেষ হলে পর ফিরে এলাম আমার অফিসে। ধার করলাম রিচার্ড কার্পেন্টারের ইয়া মোটা ফাইলটা। ১৯৫৩ সালের ডিসেম্বর মাস থেকে লোকটাকে খুঁজছি আমরা। উচ্চতায় সে পাঁচ-ফুট এগারো ইঞ্চি। ওজন ১৬৫ পাউন্ড। মাঝে মাঝে গোঁফ রাখে। কোটরে-বসা চোখ। বয়স ছাব্বিশ বছর। বিস্তর ডাকাতির মামলা ঝুলছে তার নামে। কিন্তু গত পনেরো মাস যাবৎ আরও ঘন ঘন আর বেশি সংখ্যায় রিপোর্ট আসা শুরু হয়েছে তার কীর্তিকলাপের ধরন দেখে মনে হয় শিকাগো শহরের বাইরে সে কোনও দিনই যায়নি। মুদিখানা, পেট্রোল পাম্প, পানাগার, হোটেল, লন্ড্রি ইত্যাদি ছোটখাটো জায়গায় ক্ষমতা জাহির করেই খুশি সে৷ ছদ্মবেশ ধারণের প্রচেষ্টা কোনও দিনই করেনি কার্পেন্টার এবং একলা কাজ করাই পছন্দ করে সে। এখনও কাউকে সে যমালয়ে পাঠায়নি বটে, তবে আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস একদিন না একদিন সে তা করবেই।