দেখেছি।
তার ক্যাপটা?
দেখেছি।
দেখোনি। দেখলে পাফটা দেখতে পেতে। ভেতর দিকে ছোট্ট একটা মখমলের পাফ লাগানো ছিল আগে থেকেই–টয়লেট-কিট যারা তৈরি করেছে, তারাই লাগিয়ে দিয়েছে। সুতরাং বউদি, অতীব দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি, খুনির কাছাকাছি এসেও পাশ কাটিয়ে গেলে সব চাইতে মজার ব্যাপার, তিনজনেই খুনি সাব্যস্ত করলে একজন স্ত্রীলোককে। অথচ আমার হিসেব অনুযায়ী হত্যাকারী একজন পুরুষ।
প্রমাণ? বন্দুকের বুলেটের মতো প্রশ্ন নিক্ষেপ করলাম আমি।
সামনেই ছিল। কিন্তু চোখের ব্যবহার করোনি–প্রত্যেকেই আগে থেকেই ভেবে নেওয়া সিদ্ধান্তকে কায়েমি করার মতলবে অমন চোখে আঙুল দেওয়া প্রমাণ দেখেও দেখোনি। আমি আটটা ঝিনুকের বোতাম আর ধাতুর টুকরো দুটোর কথা বলছি।
যে ফায়ারপ্লেসে কখনো আগুন জ্বলে না, সেখানে খানিকটা ছাই পড়ে। টংগু লিনচান নিশ্চয় হাত-পা ছড়িয়ে বসার আগে কিছু পোড়ানোর জন্যে ব্যস্ত হননি। তবে কাজটা কার? নিশ্চয়ই হত্যাকারীর। আগুন জ্বালিয়ে প্রমাণ নিশ্চিহ্ন করার অপচেষ্টা। ছাইটা কাগজের নয়, কাঠের নয়, কয়লার নয়। ছাইয়ের গাদায় পড়ে আটটা পোড়া বোতাম। ছটা ছোট, দুটো বড়। পৃথিবীতে একটিমাত্র জিনিসই আছে যার মধ্যে থাকে এই আটটা বস্তু। শার্ট। ওপেন ব্রেস্ট ফুলশার্টের সামনে থাকে ছটা ছোট বোতাম আর দু-হাতায় দুটো বড় বোতাম। ছাইটা কাপড়ের। অর্থাৎ ফায়ারপ্লেসে কেউ একটা ফুলশার্ট পুড়িয়েছে–পোড়াবার সময়ে খেয়ালই ছিল না যে ঝিনুকের বোতাম আগুনকেও কদলী প্রদর্শন করতে পারে।
এবার ধাতুর জিনিস দুটো। একটা তেকোণা আর একটা আঁকশি। ওপেনব্রেস্ট ফুলশার্ট যে পরে, সে টাউজার্স পরে। আর টাউজার্স যে পরে, সাধারণত সে টাই পরে। ধাতুর জিনিস দুটোও এসেছে বো-টাই থেকে। রেডিমেড বো-টাই বাজারে কিনতে পাওয়া যায় কিনলে বোবাঁধার ঝাট পোহাতে হয় না।
লম্বোদরবাবু, আপনি বললেন বটে, টংগু লিনচান রক্তমাখা হাতে কিছু একটা আঁকড়ে ধরেছিলেন। কিন্তু সেটা যে হত্যাকারীর শার্ট হতে পারে, তা বললেন না। বিছানার চাদর দেখেই তো বোঝা যায় ধস্তাধস্তি হয়েছে। মাথায় প্রথম বাড়ি খেয়ে লড়েছেন মিঃ লিনচান, খামচে ধরেছিলেন হত্যাকারীর শার্ট আর বো-টাই। কিন্তু তবুও প্রাণে বাঁচেননি।
লুটিয়ে পড়লেন মিঃ লিনচান। এদিকে হত্যাকারী পড়ল বিপদে। রক্তমাখা শার্ট আর বো-টাই নিয়ে বেরোনো যায় কী করে? হত্যাকারী যদি হোটেলের বাইরের লোক হত অথবা হোটেলের বোর্ডার হত, তাহলে কোটের কলার তুলে বো-টাই ঢেকে বেরিয়ে গেলেই কারো সন্দেহ হত না। বে-টাই যে পরে, সে কোটও পরে। কিন্তু তা না করে হত্যাকারী রক্তমাখা শার্ট আর বো-টাই আগুনে পুড়িয়ে মিঃ লিনচানের ব্যাগ হাঁটকে সাদা শার্ট আর বো-টাই পরে বেরিয়ে গেছে। এইজন্যেই ব্যাগের মধ্যে লম্বা নেকটাই পাওয়া গেছে। কিন্তু বো-টাই পাওয়া যায়নি। ইভনিং সুটের পাশেও তা ছিল না।
হত্যাকারী তাহলে বাইরের লোক নয়, বোর্ডারও নয়। তাহলে কি হোটেলেরই কর্মচারী? নিশ্চয়ই তাই। কেননা, কর্তব্যরত অবস্থায় রাঁদেভু হোটেলের প্রত্যেকেই ফিটফাট থাকতে হয়। ডিউটি ছেড়ে কোথাও যাওয়াও সম্ভব নয়। তাই নিজের শার্ট আর বো-টাই পুড়িয়ে পরের শার্ট আর বো-টাই পরে ফিরে যেতে হয়েছে তাকে ডিউটিতে।
আমরা যখন তদন্ত করছি, হত্যাকারী তখন হোটেলেই অন ডিউটিতে রয়েছে। পরনে আছে সাদা শার্ট আর কালো অথবা সাদা বো-টাই। খুব সম্ভব কালো। কিন্তু আমরা দেখেছি রাঁদেভু হোটেলের প্রত্যেক কর্মচারীর শার্টের রং ধূসর, টাইয়ের রং ধূসর। শুধু একজনের বাদে…হোটেলে ঢুকেই তফাতটা নিশ্চয় লক্ষ করেছিলে?
করোনি? অন্ধ অন্ধ, তোমরা তিনজনেই চোখ থেকেও অন্ধ। যাকগে, তোমরা বিদেয় হতেই জয়ন্তকে নিয়ে সেই একজনকে জেরা করতেই সব ফাঁস হয়ে গেল। তারপর শার্ট পরীক্ষা করতেই পাওয়া গেল সেই একই ওস্তাগরের লেবেল–ম্যাকিনস, জোহানেসবার্গ অর্থাৎ সাউথ আফ্রিকায় তৈরি জামা যেখানে বছরখানেক থেকে এসেছেন টংগু লিনচান কিন্তু আমাদের সন্দেহভাজন ব্যক্তিটি যে দেশে জীবনে যায়নি।
তিন মিনিটের মধ্যেই সবকিছু স্বীকার করে বসল হত্যাকারী। অনেক দিন আগেই তার বউকেই ভাগিয়ে নিয়ে গেছিলেন টংগু লিনচান, তারপর প্রয়োজন ফুরোতেই ছেঁড়া ন্যাকড়ার মতো ফেলে এসেছেন। হপ্তাখানেক আগে রাঁদেভু হোটেলে নাম লিখতেই হত্যাকারী তাকে চিনেছে এবং প্রতিশোধ নেওয়ার প্ল্যান এঁটেছে। আজ সকালে ঢাকা থেকে ফিরতে না ফিরতেই হাতুড়ি পেটা করে যমালয়ে পাঠিয়ে শোধ নিয়েছে স্ত্রী-হরণের।
আলোকিত চোখে বললাম–হত্যাকারী তাহলে–
হোটেল ম্যানেজার মিঃ পিটার ড্যানিয়েল, বলে কাচির প্যাকেট হাতড়াতে লাগল ইন্দ্রনাথ রুদ্র। * সিনেমা জগৎ (জুন, ১৯৬৯) পত্রিকায় প্রকাশিত।
আদুরে খোকা
রাত তখন দুটো।
টেলিফোন এল শিকাগোর সীমানা ঘাঁটি থেকে। রাইটউড অ্যাভিন্যুতে ছোট্ট একটা পানাগারে এইমাত্র একটা রাহাজানি হয়ে গেল। টেলিফোনেই ঘটনাটার খুঁটিনাটি বিবরণ শুনলাম কর্তব্যরত সার্জেন্টের কাছ থেকে।
জায়গাটা শহরের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে। কাজেই চট করে একটা গাড়ি নিয়ে ঝটিতি পৌঁছে গেলাম অকুস্থলে। গিয়েই দেখা হয়ে গেল মার্টিন চৌয়ানস্কির সঙ্গে। দারুণ উত্তেজনায় প্রায় লাফাচ্ছিলেন ভদ্রলোক। ধড়ে যে তখনও প্রাণটা রয়ে গেছে, এ জন্যেও আনন্দের অবধি ছিল না তার। ভয়ে প্রাণ উড়ে গিয়েছিল ভদ্রলোকের এবং সেই বৃত্তান্তই আমাকে বলতে পেরে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন।