সঙ্গে-সঙ্গে কবিতা বললে–ঘড়ির সূত্রটা কোনও সূত্রই নয়। এ নিয়ে এতটা সময় নষ্ট করা স্রেফ আহাম্মকি।
তেড়ে উঠে বললাম–বাজে কথা না বলে প্রমাণ করো এটা কোনও সূত্রই নয়।
করবই তো, সমান তেজে জবাব দিল কবিতা। পাকিস্তান সময় আর ভারতীয় সময়ের তফাতটা জানা আছে?
বিদ্রূপতরল কণ্ঠে বললাম–তার সঙ্গে খুনের সম্পর্ক কি?
কণ্ঠে ততোধিক শ্লেষ ঢেলে কবিতা বলল–সেইটাই তো একমাত্র সম্পর্ক। ঘড়িটা টংগু লিনচানেরই। ঢাকায় গিয়ে তিনি পাকিস্তানের ঘড়ির সঙ্গে সময় মিলিয়েছেন। কলকাতায় এসে এখানকার সময়ের সঙ্গে ঘড়ি মিলনোর ফুরসৎ পাননি। কে না জানে, ঢাকার সঙ্গে ইন্ডিয়ার সময়ের তফাত পুরো আধ ঘণ্টা। মানে, ঢাকায় যখন বারোটা, এখানে তখন সাড়ে এগারোটা।
মেশিনগানের মতো মোক্ষম যুক্তি বর্ষণে মুখ শুকিয়ে গেল আমার। লম্বোদরবাবুর মুখটা আবার লম্বা হয়ে গেল। আর ধীরে ধীরে উজ্জ্বল হয়ে উঠল ইন্দ্রনাথের চোখ।
বলল–ক্যাপিটাল বউদি, ক্যাপিটাল। শার্লক হোমস হওয়ার যোগ্যতা একমাত্র তোমারই আছে। এ পর্যন্ত ঠিকই বললে, তারপর?
খুনি কে, তা আমি জানি। না, না টংগুর তালাক দেওয়া বউ নয়, পারুলও নয়। আগে শোনোই না। সবাই দেখেছ, মিঃ লিনচানের মুখের পাউডারের প্রলেপ। খুব মসৃণ প্রলেপ। গাল আর সেভিং সেটের অবস্থা দেখে জানা গেল খুন হওয়ার ঠিক আগেই দাড়ি কামিয়েছেন তিনি। ঠাকুরপো, দাড়ি কামানোর পর তুমিও পাউডার লাগাও।
লাগাই বই কি।
কীভাবে লাগাও?
এটা আবার কি প্রশ্ন?
বলোই না, কীভাবে লাগাও?
কেন আঙুল দিয়ে লাগাই।
ঠিক। আমার কর্তাটিরও সেই অভ্যেস। আশা করি, লম্বোদরবাবুরও। আসলে পুরুষমাত্রই গালে পাফ লাগানোর ধার ধারে না। তাই তারা আঙুলে করে পাউডার নিয়ে গালে ঘষে দেয়। ফলে জ্যাবড়া হয়ে কোথাও বেশি কোথাও কম ভাবে লেগে থাকে পাউডার। কিন্তু মেয়েরা পাফ ছাড়া পাউডার লাগায় না। তাই তাদের মুখে পাউডার অমন মোলায়েম ভাবে মাখানো থাকে। যেমন আমার। পাউডার মেখেছি বলে মনে হয়?
তা হচ্ছে বই কি–
হলেও তোমাদের মতো অত বিশ্রিভাবে মনে হয় না, ঝটিতি জবাব দিল কবিতা। টংগু লিনচানের মুখে কিন্তু যেভাবে পাউডার লাগানো হয়েছে, তা পাফ ছাড়া লাগানো সম্ভব নয়। কিন্তু তার ঘরে তন্নতন্ন করে খুঁজেও পাফ পাওয়া যায়নি।
এতক্ষণ রুদ্ধশ্বাসে শুনছিল ইন্দ্রনাথ। এবার যেন স্বস্তির নিঃশ্বেস ফেলে বললে–তাহলে বউদি, তুমি বলতে চাও যে, টুংগু লিনচানের দাড়ি কামানো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখল একজন মেয়েছেলে, কামানো শেষ হলে আদর করে নিজের ভ্যানিটিব্যাগ খুলে পাউডারও মাখিয়ে দিলে ভদ্রলোককে এবং তার পরেই দমাস করে পাথরের হাতুড়ি মেরে গুঁড়িয়ে দিল মাথা। তাও কি সম্ভব?
ডাইভোর্স করা বউয়ের পক্ষে সম্ভব না হতে পারে, কিন্তু রক্ষিতার পক্ষে সম্ভব। একমাত্র তারাই আগের মুহূর্তে দেবী, পরের মুহূর্তে দানবী হতে পারে। টংগু লিনচানের কলকাত্তাই প্রেয়সী ভায়োলেট অ্যালক্যাটরার সঙ্গে ঘন্টাখানেক আগেই দেখা করে এসেছি আমি। জ্ঞানপাপী তো, তাই কিছুতেই স্বীকার করতে চাইল না যে টংগু লিনচানকে পাউডার মাখিয়ে এসেছে আজ সকালে।
পোড়া সিগারেটটা টোকা মেরে জানলাপথে উধাও করে দিয়ে ইন্দ্রনাথ বললে–তোমরা তিনজনেই মৌলিকতার পরিচয় দিয়েছ। প্রত্যেকেই নিজের নিজের যুক্তি অনুযায়ী নিজস্ব থিওরি গড়ে নিয়েছ। সেজন্যে আরিফ করছি তিনজনকেই। তবে কি জানো
কী? সমস্বরে জিগ্যেস করি আমরা।
তোমরা তিনজনেই ভুল করেছ।
কিছুক্ষণ সব চুপ।
তারপর, শাড়ির খুঁট আঙুলে পাকাতে পাকাতে বাঁকা সুরে কবিতা বলে উঠল–তোমার মতো দেমাকি মানুষের কাছ থেকে ঠিক এই কথাটাই শোনার আশায় ছিলাম এতক্ষণ।
আরে! আরে! আবার সেই মেয়েলি অভিমান। ঠোঁট না ফুলিয়ে আমার দুটো কথা যদি দয়া করে শ্রবণ করো, তাহলেই বুঝবে কেন বললাম তিনজনেই ভুল করেছ।
ভণিতা না করে বললেই হয়।
তোমরা তিনজনেই সেই একই ভুল করেছ। অর্থাৎ, চোখ-কান খোলা রেখে নতুন নতুন সূত্রকে কাজে না লাগিয়ে আগে থেকেই গড়ে নেওয়া থিওরিকেই খাড়া করার জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা করেছ। একই সূত্র ধরে একই যুক্তির পথ বেয়ে প্রত্যেকেই চোখ-কান বুজে দৌড়েছ নিজের নিজের সিদ্ধান্তের দিকে। আশপাশে তাকাওনি। তাই ফেল করলে শোচনীয় ভাবে।
লম্বোদরবাবু, আপনার থিওরি ঝুলছে একটি মাত্র সুতোর ওপর–গোল করে কেটে নেওয়া ফটো। কিন্তু সেটা তো নেহাতই কাকতালীয় হতে পারে। এর বশে তো কোনও ভদ্রমহিলাকে খুনি সাব্যস্ত করা যায় না। যায় কি? অসম্ভব।
মৃগাঙ্ক, তুমি যে এমন আনাড়ির মতো থিওরি খাড়া করবে, আশা করিনি। রং মিলিয়ে ফেস পাউডার ব্যবহার করা অথবা হাতে রিস্টওয়াচ পরা পারুল কেন, বাংলাদেশের ঝি-শ্রেণির কোনও মেয়ের পক্ষেই সম্ভব নয়।
আশা ছিল বউদির ওপর। ঢাকার সময়ের সঙ্গে ইন্ডিয়ান স্ট্যান্ডার্ড টাইমের প্রভেদটুকু পর্যন্ত তুমি দিব্বি বললে। ভয় হয়েছিল, হয়তো টেক্কা মারবে আমার ওপর। কিন্তু যে বনেদের ওপর তোমার থিওরি খাড়া করলে, গোড়ায় গদল রয়ে গেল সেইখানেই। তুমি বলছ, পাফ দিয়ে পাউডার মেখেছেন টংগু লিনচান, অথচ ঘরে পাফ নেই। কিন্তু আমি বলব আছে।
কোথায়?
শেভিং ব্রাশ রাখার প্লাস্টিক কৌটোটা দেখেছ?