আমার একটা ঠিকানা চাই।
ফস করে কবিতা বলে উঠল–আরে, আমিও তো তা চাই।
আমি বললাম–আমি চাই এমন একটা জিনিস যা এই হোটেলেই আছে।
বেশ তো, স্মিত মুখে বলল ইন্দ্রনাথ। তোমাদের যা যা দরকার, একতলায় সার্জেন্ট অচল দত্তের কাছে চেয়ে নাও। তারপর দু-ঘণ্টা সময় দিলাম। দু-ঘণ্টা পরে সন্ধে সাড়ে ছটার সময়ে আমার মেসে এসে দেখা করো। দেখা যাক কার দৌড় কদ্দূর পর্যন্ত।
সবার আগে ঘর থেকে বেরুল কবিতা এবং সবার শেষে আমি। বেরুতে বেরুতে শুনলাম ইন্দ্রনাথ বলছে–ওহে জয়ন্ত, তোমার সঙ্গে আমার কিছু সিরিয়াস আলোচনা আছে।
দু-ঘণ্টা পর। ইন্দ্রনাথের মেস। সেই ভাঙা তক্তপোষ, নড়বড়ে চেয়ার আর টেবিল।
কলের পুতুলের মতোই এতক্ষণ চা-বিস্কুট খাচ্ছিল লম্বোদবাবু আর কবিতা। আমি মৌনীবাবা হয়ে গেছিলাম সাময়িকভাবে।
একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে ইন্দ্রনাথ বললে–আর দেরি কেন? লম্বোদরবাবু, বলুন আপনার সিদ্ধান্ত।
শুধু সিদ্ধান্তই নয় ইন্দ্রনাথবাবু, তার চেয়েও এক কাঠি এগিয়েছি আমি।
যথা?
সমাধানে পৌঁছেছি।
তাই নাকি! তাই নাকি! কীভাবে পৌঁছলেন বলুন তো?
আমার একমাত্র সূত্র হল রিস্টওয়াচটা। চামড়ার ব্যান্ডে দুটো দাগ। যে দাগটা সবচাইতে কম গভীর–সেই দাগেই ঘড়ি পরে আছেন টংগু লিনচান। এই থেকেই সিদ্ধান্তে পৌঁছলাম যে ঘড়িটা আসলে তাঁর নয়।
তবে কার?
হত্যাকারীর।
কিন্তু অকুস্থলে হত্যাকারী নিজের ঘড়ি ফেলে যাবে কেন?
পুলিশকে বিপথে চালনা করার জন্যে। ডাক্তার বলছেন, মিঃ লিনচান মারা গেছেন এগারোটা থেকে এগারোটা তিরিশ মিনিটের মধ্যে। কিন্তু তা সত্ত্বেও ঘড়ির কাটা দাঁড়িয়ে গেছে এগারোটা পঞ্চাশ মিনিটে। কেন?
কেন?
কারণ, হত্যাকারী খুন করার সময়টা ইচ্ছে করেই এগিয়ে দিতে চেয়েছে। অথচ নিহতর হাতে ঘড়ি নেই। তাই নিজের হাতের ঘড়ি খুলে আছড়ে মেরে কাঁচ ফাটিয়েছে, কলকজা বিগড়েচে–
তারপর কাটা ঘুরিয়ে এগারোটা পঞ্চাশ মিনিটের ঘরে এনে পরিয়ে দিয়েছে মিঃ লিনচানের কব্জিতে। কিন্তু তার কব্জি মোটা অথচ হত্যাকারীর কব্জি সরু–তাই ব্যান্ডটা লাগল অন্য ঘাঁটিতে।
ব্রিলিয়ান্ট। কিন্তু এটা তো সমাধান হল না। হত্যাকারী কে?
হত্যাকারী একজন স্ত্রীলোক। তাই তার কব্জি সরু।
বটে! বটে। কিন্তু কে সে?
টংগু লিনচানের তালাক দেওয়া বউ। খুনের মোটিভ, গায়ের জ্বালা মিটানো।
শুনে নাকের ডগাটা সামান্য কুঁচকালো কবিতা। আমিও বিশেষ উৎসাহ বোধ করলাম না। দেখে শুনে মিইয়ে গেল লম্বোদর লস্কর। মিনমিনে স্বরে বললে–আরও প্রমাণ আছে।
আছে নাকি?
ঘড়ির পেছনের ডালায় ভেতর দিকে খানিকটা ছেঁড়া কাগজ লেগে ছিল। যেন টান মেরে কিছু ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে। ঘড়ির ভেতরে একটি জিনিসই রাখার রেওয়াজ ছিল এককালে-ফটোগ্রাফ। টংগু লিনচানের ঘড়িতেও ছিল একটা ফটো এবং সে ফোটোতেই সম্ভবত ছিল হত্যাকারীর চেহারা। তাই যাবার সময়ে ছিঁড়ে নিয়ে গেছে ছবিটা। আমি রিপোর্টারের ছদ্মবেশে দেখা করলাম মিঃ লিনচানের আগের বউয়ের সঙ্গে। তার টেবিলেই একটা ফ্যামিলি অ্যালবাম দেখলাম। একটু নাড়াচাড়া করতেই পেলাম একটা ফটোগ্রাফ–একজন পুরুষ আর স্ত্রী পাশাপাশি দাঁড়িয়ে। কিন্তু তাদের মুন্ডুদুটোই নেই–গোল করে কেটে ফটো থেকে তুলে নেওয়া হয়েছে–রয়েছে শুধু ধড়। আর প্রমাণের দরকার আছে?
ঈষৎ দমে গিয়ে বললে ইন্দ্রনাথ–না, আর দরকার নেই। মৃগাঙ্ক, তোমার সিদ্ধান্ত?
লম্বোদরবাবুর মতো আমারও সূত্র ওই ঘড়ি, বললাম আমি। তবে ব্যান্ড নিয়ে অযথা মাথা ঘামাইনি। ঘামিয়েছি ঘড়ির শ্বাসপ্রশ্বাস নিয়ে।
ঘড়ির আবার শ্বাসপ্রশ্বাস! বলো কি হে?
ঘাবড়াও মৎ। জগদীশ বোসের থিওরি আওড়াচ্ছি না। তবে ঘড়িও নিশ্বেস নেয়, নিশ্বেস ছাড়ে।
ভারি ইন্টারেস্টিং ব্যাপার তো। রীতিমতো গবেষণা।
ঠাট্টা করো না। হাতের চামড়ায় ঘড়ি লেগে থাকার সময়ে গায়ের উত্তাপে ঘড়ির ভেতরকার বাতাসও গরম হয়ে প্রসারিত হয়ে যায়। আয়তনে বেড়ে যায়। আয়তনে বেড়ে যাওয়ার ফলে বাতাস পেরিয়ে যায় কাঁচের ফাঁক দিয়ে, ছোটখাটো চিড় দিয়ে। সেকেলে ঘড়ির ক্ষেত্রে এ জিনিসটা আরও বেশি দেখা যায়। টংগু লিনচানের ঘড়িও আধুনিক নয়।
বেশ।
ঘড়ি যখন হাত থেকে খুলে নামিয়ে রাখা হয়, তখন ভেতরের বাতাসও আবার ঠান্ডা হয়ে সঙ্কুচিত হয়। ফলে বাইরের বাতাস ফুটো কাঁচের ফাঁক দিয়ে ঢুকে পড়ে ভেতরে। সেই সঙ্গে বাতাসের ধুলোও পথ করে নেয় ভেতরে।
তারপর?
সেই কারণেই, রুটিওলার ঘড়িতে পাওয়া যায় ময়দার ধুলো, ইটের পাঁজার মালিকের ঘড়িতে জমে ইটের ধুলো। টংগু লিনচানের ঘড়িতে কি পেয়েছি জানো?
কী?
মেয়েদের ফেস-পাউডার।
বটে!
জানো তো, খুঁতখুঁতে মেয়েরা গায়ের রং মিলিয়ে ফেস পাউডার কেনে। ঘড়ির মধ্যে যে ফেস পাউডার পেলাম তা সাধারণত কালো মেয়েরাই ব্যবহার করে।
এবং সে কালো মেয়েটি কে? ইন্দ্রনাথের স্বর এবার তীক্ষ্ণ।
বুক ভরে বিশ্বাস নিয়ে সগর্বে বললাম–পারুল।
ভীষণ চমকে উঠল ইন্দ্রনাথ–পারুল কি হে?
কেন নয়? দুশ্চরিত্র টংগু লিনচান নিশ্চয় পারুলের গায়ে হাত দিতে গেছিল, তাই–
খুক খুক শব্দ শুনে দেখি মুখে শাড়ির খুঁট চাপা দিয়ে ওদিকে তাকিয়ে আছে কবিতা।
গরম হয়ে বললাম–এত হাসি কীসের?
জবাব দিলে ইন্দ্রনাথ। বলল–বউদি হাসছে পর্বতের মূষিক প্রসব দেখে। সাধে কি বলি গল্প লিখলে ঘিলু কমে যায়। আরে ব্রাদার, পারুলকে দেখে মনে হয় কি ফেস পাউডারের বিলাসিতা করার মতো সখ অথবা সাধ্য তার আছে? ঘড়ি পরা তো দূরের কথা। দূর, দূর। বউদি, তুমিই শুধু বাকি রইলে। শোনাও তোমার থিওরি।