তাই ডায়মন্ডহারবারে খুলেছে স্টুডিও। হীরক বন্দর। কিন্তু এত জায়গা থাকতে হীরক বন্দরকে পছন্দ হল কেন? সল্টলেকে তো অনেক সুবিধে।
সেখানেও তো রয়েছে কুমতোলব।
যেমন?
যত রিসর্ট তো এই ডায়মন্ডহারবারেই। কলকাতা থেকে গিয়ে এক রাতের ফুর্তি সেরে ভালোমানুষের মতো ফিরছে কলকাতায় যে যার বাড়ি। উচ্ছন্নে গেছে দেশটা। উচ্ছন্নে পাঠাচ্ছে এই চন্দ্রকান্তর মতন স্কাউলেরা। স্টুডিওর একপাশে রেখেছে রিসর্ট। বার। জুয়োর আড্ডা। সবই বেআইনি। কিন্তু ম্যানেজ করে চলেছে চন্দ্রকান্ত। ওইজন্যেই তো খুনের খবর আগে পুলিশকে না দিয়ে দিল আপনাকে।
পুলিশকে দেয়নি জানছেন কী করে?
চন্দ্রকান্তকে আমি হাড়ে হাড়ে চিনে ফেলেছি। গরিলার বাচ্চা কোথাকার! লাশ পর্যন্ত উড়িয়ে দিতে পারে।
এই লাশটা কি দুর্যোধনের বলে মনে হয়?
হলে আশ্চর্য হব না।
কদ্দিন গাড়ি চালাচ্ছে আপনার?
বছরখানেক। চন্দ্রকান্তই দিয়েছে। স্লট মেশিনে জুয়োর আড্ডায় ঢুকিয়েছিল নিজের লোক। খুব বিশ্বাস করে। আমার গাড়ির ভার ওকে দিয়েছে তো ওই মতলবেই। আমি এদিক ওদিক করলে খবর যেন পায় চন্দ্রকান্ত। জানেন তো ড্রাইভারগুলোই হয় স্পাই।
চন্দ্রকান্তর লোক দুর্যোধন? জুয়ো খেলার স্লট মেশিনের নাড়ি নক্ষত্র জানে?
হ্যাঁ।
পুরো নাম কি দুর্যোধন পাড়োয়াল?
এইবার চকিতে ইন্দ্রনাথের দিকে চোখ ফিরিয়েই ফের রাস্তার দিকে তাকাল সিনথিয়া, চেনেন মনে হচ্ছে?
এ নাম একবার শুনলে ভোলা যায় না। নামের জন্য অনেকে বিখ্যাত হয়ে থাকে। দুর্যোধন পাড়োয়াল বিখ্যাত আর এক কারণে। জানেন কী কারণে?
সত্যি জানি না।
বছরতিনেক আগে জলপাইগুড়ি জেলের পাঁচিল টপকে পালিয়েছিল দুর্যোধন। অদ্ভুত বুদ্ধি খাঁটিয়ে। জেলখানায় ইলেকট্রিক্যাল কানেকশনের জন্যে এখানে সেখানে পড়েছিল লোহার পাইপ। সেইসব পাইপ একটা-একটা করে জেলখানার ভেতরেই বাথরুমের পেছনে কঁকা জায়গায় জড়ো করেছিল দুর্যোধন। জেলখানার গুদোমে ছিল নুনের বস্তা। নাইনলের দড়ি খুলে নিয়েছিল সেইসব বস্তা থেকে। লোহার পাইপগুলোকে পরপর বেঁধে তৈরি করেছিল সিঁড়ি। এই সিঁড়ি বেয়ে জেলখানার চোদ্দো ফুট পাঁচিল টপকেছিল দুর্যোধন।
ব্রিলিয়ান্ট ব্রেন। ফস করে বলে ফেলেই সামলে নিল সিনথিয়া, পুলিশ আর ওকে ধরতে পারেনি?
পুলিশের কত কাজ। ইন্ডিয়াটা বিরাট। যেন উবে গেছিল দুর্যোধন পাড়োয়াল। এখন তো দেখছি জহুরী চন্দ্রকান্ত ঠিক জহর চিনেছে।
নাকের পাটা শক্ত করে সিনথিয়া বললে, নইলে ক্রাইমের ব্যাবসা চালাবে কী করে?
.
সমুদ্র নীল পোশাক পরা অপরূপা সিনথিয়ার সামনে চন্দ্রকান্ত ভরদ্বাজকে গরিলার বাচ্চার মতনই লাগছিল। বিশেষণটা মন্দ দেয়নি সিনথিয়া।
ওরা এখন দাঁড়িয়ে আছে চন্দ্রকান্তর খাস কামরায়। দরজায় দাঁড়িয়ে রিভলভার হাতে চন্দ্রকান্তর দেহরক্ষী। তার গায়ের রং কষ্টি পাথরকে হার মানায়। বসনও কুচকুচে কালো। দেখলে ভয় হয়। এই মুহূর্তে তার মাথায় বিরাট ব্যান্ডেজ। হঠাৎ দেখলে মনে হবে শিখদের পাগড়ি।
অঘটনের পর অঘটন ঘটে চলেছে এখানে। হিরের কলম চুরি গেছে। জুয়ো খেলার ঘরের সামনে মুখোশধারী দুজন দুশমন দুর্যোধনের খুলি চুরমার করেছে, ব্ল্যাক কমান্ডোর আয়ু ছিল বলে মাথায় ডাণ্ডা খেয়েও বেঁচে আছে।
পুরো স্টুডিও আর রিসর্ট এরিয়া পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। বাইরে থেকে কিছু বোঝা যায় না। যেন, চায়না টাউন। জবরদস্ত সিকিউরিটি এজেন্সির হাতে পাহারাদারির ভার তুলে দিয়েছে চন্দ্রকান্ত। নিকষকালো এই ব্ল্যাক কমান্ডোই সিকিউরিটি চিফ। তার নাম অর্জুন পাণ্ডে।
এইমাত্র ঘটনা পরম্পরাগুলো তিনজনের মুখে শুনে নিয়েছে ইন্দ্রনাথ। অর্জুন কালো পাথরের থামের মতোন দাঁড়িয়ে আছে দরজার কাছে। ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে ইন্দ্রনাথ, গিলে করা অর্গান্ডির পাঞ্জাবি আর চুনোট করা ধুতির বাবুয়ানি দেখে মনে হতে পারে হিরোর ভূমিকায় অবতীর্ণ হতেই তার আগমন ঘটেছে স্টুডিওতে। ইন্দ্রনাথের একপাশে গোল কাঁধ আরও গোল করে আর বিশাল লম্বা হাত দুখানা প্রায় হাঁটু পর্যন্ত ঝুলিয়ে গনগনে চোখে সিনথিয়ার দিকে চেয়ে আছে চন্দ্রকান্ত ভরদ্বাজ। সিনথিয়াও তার অনিন্দ্যসুন্দর চক্ষুরত্ন দুটোকে একজোড়া মরকত গুলি বানিয়ে চেয়ে আছে চন্দ্রকান্তর দিকে। এই মুহূর্তে তার হাতে এসে গেছে আর একটা বস্তু। একটা ছোট্ট রিভলভার। ডান হাতে অস্ত্রটাকে বাগিয়ে ধরে চন্দ্রকান্তর দিকে নলচে ফিরিয়ে নাচাচ্ছে আর চেঁচাচ্ছে, দুর্যোধনকে তুমিই খুন করেছ, ঈর্ষায় অন্ধ হয়ে গিয়ে–ইউ মার্ডারার।
ইন্দ্রনাথ খুব ঠান্ডা গলায় বললে, এই কোঁদলের মধ্যে আমাকে টেনে আনার দরকার ছিল না। লেডি সিনথিয়া, এই মাত্র কী শুনলেন? আপনি যখন শুটিংয়ে ক্যামেরার সামনে, তখন দুর্যোধন পা টিপেটিপে, চোরের মতন এদিক-ওদিক দেখতে-দেখতে গ্রিনরুমে ঢুকছিল। অর্জুন পাণ্ডে, আপনি দেখেছিলেন?
কষ্টিপাথর অর্জুন বললে পাথুরে গলায়, ওইভাবে ঢুকতে দেখেই তো আমার খটকা লেগেছিল। কিন্তু তা নিয়ে ভাবিনি। তারপর যখন সিনথিয়া দেবী গ্রিনরুমে ঢুকেই গলা চিরে চিৎকার করে উঠলেন, তখনই বুঝলাম, হিরের কলম চুরির মতোলবেই গ্রিনরুমে ঢুকেছিল দুর্যোধন। তখুনি দৌড়লাম তার খোঁজে। দেখলাম, ডেডবডি মুখ থুবড়ে পড়ে রয়েছে জুয়ো ঘরের দরজার সামনে। মাথার ঘিলু বেরিয়ে এসেছে ভাঙা করোটির ফাঁক দিয়ে। পকেটে কিন্তু হিরের কলম নেই। ভাবলাম, জুয়ো ঘরের মধ্যে রেখেছে। ঢুকতে যাচ্ছি, মাথায় পড়ল ডাণ্ডা। জ্ঞান হারানোর আগে দেখেছিলাম কালো মুখোশ পরা দুটো লোককে। নেহাত নিরেট মাথা, তাই বেঁচে গেছি। স্যার, চোরের ওপর বাটপারি হয়েছে। গ্রিনরুম থেকে চুরি করেছে দুর্যোধন, দুর্যোধনকে খতম করে হিরে নিয়ে পালিয়েছে দুই দুশমন।