সময় আপনাকে করতেই হবে। কলমের বাতিক আমার নেই। কিন্তু জড়োয়া কলমদের কোন মেয়ে ভালোবাসে না?
জড়োয়া কলম?
ইয়েস স্যার, ইয়েস স্যার। রত্ন বসানো মোগল আমলের কলম, হিরে বসানো নিরেট সোনার কলম, জুয়েল সেট করা ডাইনোসর কলম–মোট তেরখানা এইরকম কলম। দাম শুনলে আপনার মাথা ঘুরে যাবে, তাই বলব না। আপনার মাথা ঘুরে গেলে আমার জুয়েল পেন আর ফিরে আসবে না। জুয়েল পেন ফিরে না এলে আমার মাথা কাটা যাবে। চন্দ্রকান্ত ভরদ্বাজ আমাকে চোর বলবে। বলবে, বউ হব বলে ভড়কি দিয়ে কলমগুলো হাতিয়ে নিয়ে আর বউ হতে চাইছি না। কুৎসা ডালপালা মেলে ছড়িয়ে পড়বে। মিস্টার ইন্দ্রনাথ রুদ্র, আমাকে বাঁচান। বলে ইন্দ্রনাথের দুহাত জড়িয়ে ধরল সিনথিয়া।
ইন্দ্রনাথ বললে, দেখুন, আমি ব্যাচেলর মানুষ। মেয়েরা আমাকে ছুঁয়ে ফেললে আমার সব গোলমাল হয়ে যায়। আপনি একটু সরে বসুন।
ঝট করে সরে বসে, তর্জনি তুলে, শাসনের চোখে সিনথিয়া বললে, তাহলে খুঁজে দেবেন?
চন্দ্রকান্ত ভরদ্বাজ লোকটা কে?
আপনি কোন জগতের লোক? ভরদ্বাজ স্টুডিওর নাম শোনেননি? ডায়মন্ডহারবারের ফেমাস স্টুডিও। লেটেস্ট স্টুডিও। টেলিফিল্ম তোলার এমন জায়গা গোটা কলকাতায় আর নেই। স্টিভেন স্পিলবার্গ বর্তে যেতেন এই স্টুডিওর সন্ধান পেলে। ওঁর লেটেস্ট ফিল্ম দ্য লস্ট ওয়ার্ল্ড এখানেই তুলতেন।
মিনমিন করে ইন্দ্রনাথ বললে, দ্য লস্ট ওয়ার্ল্ড তো টেলিফিল্ম নয়।
ওটা কথার কথা। মুম্বাইতে হিরের বিজনেস করে বাংলার জুয়েল চন্দ্রকান্ত ভরদ্বাজ এবার হলিউড-টলিউড-বলিউড-এর সঙ্গে পাল্লা দিতে নেমেছে। এতবড় খবরটা আপনার জানা উচিত ছিল।
কাষ্ঠ হেসে ইন্দ্রনাথ বললে, এই ব্যক্তির সঙ্গে ঘর করবেন ঠিক করেছিলেন?
তাহলে আর বলছি কী। আমার নাম সিনথিয়া–যেখানে সেখানে নিজেকে বাঁধি না। এনগেজমেন্ট পর্যন্ত হয়ে গেছিল। সব্বাই জেনে গেছে, আমিই ভরদ্বাজের বাগদত্তা। গতকাল ভেঙে গেল এনগেজমেন্ট। ভীষণ রাফ। আমিও কম যাই না। বিয়েই করব না অমন রাফ রাস্কেলকে। তাই আজ হিরের প্রেজেন্টেশনগুলো সব নিয়ে গেছিলাম ফিরিয়ে দেব বলে। একটা শুটিং শেষ করে গ্রিনরুমে ফিরে এসে দেখি সব লোপাট। এখন তো ভরদ্বাজ আমাকে ছেড়ে দেবে না। জিনিসগুলোও স্রেফ হিরে মুক্তো চুনি পান্না সোনাদানা নয়। আমি একটু কবিতা-টবিতা লিখি বলে, রাইটার্স এগজিবিশন থেকে বেছে-বেছে শুধু জুয়েল পেন কিনে আমাকে প্রেজেন্ট করেছিল ভরদ্বাজ। মিস্টার ইন্দ্রনাথ রুদ্র, প্লিজ রিকভার দ্য লট। আই উইল পে ইউ এ লট।
থ্যাংক্স এ লট। এই পর্যন্ত বলেছে ইন্দ্রনাথ। এমন সময় বাজল টেলিফোন। রিসিভার তুলল ইন্দ্রনাথ। তারের মধ্যে দিয়ে ভেসে এল কর্কশ কণ্ঠস্বর, মিঃ শার্লক নাকি?
ইন্দ্রনাথ বললে, অধমের নাম ইন্দ্রনাথ রুদ্র।
সেটা জেনেই ফোন করা হচ্ছে। দম্ভ ফেটে-ফেটে পড়ছে উচ্চারণ ভঙ্গিমায়। এক শ্রেণির লোক আছে, যারা মনে করে পৃথিবীটা তাদের পায়ের তলায়। তারা এইরকম গলায় কথা বলে, মিঃ শার্লক, সিনথিয়া আপনার কাছে গেছে?
আপনাকে বলে এসেছে নাকি? বলে, সিনথিয়ার দিকে চাইল ইন্দ্রনাথ। কৃত্রিম হ্রাসে চক্ষু বিস্ফারিত করল সিনথিয়া।
দুমদুম করে দম্ভের বোমা ফাটিয়ে-ফাটিয়ে বললে দাম্ভিক লোকটা, নিশ্চয় পিণ্ডি চটকাচ্ছে আমার। হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমিই সেই রাফ রাস্কেল চন্দ্রকান্ত ভরদ্বাজ। সব ব্যাচেলরের ওপরেই ওর একটু দুর্বলতা আছে। আপনার ওপরও। সেটা জেনেই ফোন করা হচ্ছে। আপনি তো নামকরা টিকটিকি। ভালো পয়সা পাবেন। এখানে একটা খুন হয়েছে। খুনিকে ধরে দিন।
ইন্দ্রনাথের গলায় আওয়াজ এবার বদলে গেল। চাইল সিনথিয়ার দিকে। বললে মাউথপিসে, কলম চুরির পরেই মানুষ খুন। কে খুন হয়েছে?
সেটা সিনথিয়াকে নিয়ে এসে দেখে যান। চেনা মাল। ও তো নিজেই গাড়ি হাঁকিয়ে গেছে। ওর গাড়িতেই চলে আসুন। ছাড়লাম।
রিসিভার নামিয়ে রেখে ইন্দ্রনাথ বললে, খুন যে হয়েছে, তাকে আপনি চেনেন? এই গেল এক নম্বর। নম্বর দুই প্রশ্ন, ড্রাইভার ছাড়াই এতটা পথ ড্রাইভ করে এলেন?
তাকে খুঁজেই পেলাম না। কিন্তু কে খুন হল?
গিয়ে দেখা যাক।
.
গাড়ি একখানা কিনেছে বটে সিনথিয়া। ভেতরে বসে মনে হবে যেন ছোটখাটো একটা পাঁচতারা হোটেল। সিনথিয়া গাড়ি চালায়ও ভালো। বেলেঘাটার সুভাষ সরোবর থেকে ডায়মণ্ডহারবারে উড়ে গেল পক্ষিরাজের বেগে–নিঃশব্দে।
যাওয়ার পথে তন্ময়চিত্ত সিনথিয়াকে খানকয়েক জুতসই প্রশ্ন করেছিল ইন্দ্রনাথ। যেমন, খুন যে হয়েছে, সে নাকি সিনথিয়ার চেনা মাল। চন্দ্রকান্ত ভরদ্বাজের ভাষায়। তার মানে, মরে গিয়েও লোকটা ভরদ্বাজের দু-চোখের বিষ হয়ে আছে। এবং তাকে চেনে সিনথিয়া। সে কে হতে পারে?
জেরায় কোণঠাসা হয়ে গিয়ে সিনথিয়াকে বলতেই হল, একটা লোকই চন্দ্রকান্ত ভরদ্বাজের দুচোখের বিষ হয়েছিল। সিনথিয়ার ড্রাইভার।
কেন? ইন্দ্রনাথের সপেটা প্রশ্ন।
জেলাসি; সিনথিয়া রাস্তার দিকে চেয়েই বলে গেল।
ড্রাইভারের সঙ্গে প্রেম-ট্রেম ছিল?
চন্দ্রকান্তর সন্দেহ হয়েছিল। গতকাল তুলকালাম কাণ্ড হয়ে গেল তো এই নিয়েই। দুর্যোধনের স্ক্রিন টেস্টের কথা বলতেই জ্বলে উঠল চন্দ্রকান্ত। ড্রাইভার হলেও সে তো মানুষ। দেখতে শুনতেও খারাপ নয়। চান্স যদি পায়, অনেক কিছু করতে পারে। ট্যালেন্ট সার্চ করতে জানে না চন্দ্রকান্ত। স্টুপিড। ডায়মণ্ড ছাড়া কিছু চেনে না।