আঙুল মটকাতে মটকাতে জয়ন্ত বললে–দেখছিলাম কখন তুমি প্রশ্নটা করো। ফায়ারপ্লেসে দারুণ ইন্টারেস্টিং কয়েকটা জিনিস পাওয়া গেছে।
ফায়ারপ্লেসের সামনে গিয়ে দাঁড়াল ইন্দ্রনাথ। ডামি ফায়ারপ্লেস। আগুন কস্মিনকালেও জ্বলে না–শুধু ইউরোপীয় পরিবেশ সৃষ্টির জন্যই তা নির্মিত। কিন্তু এ হেন চুল্লিতেই জমে খানিকটা ছাই। এবং সে ছাই অতি বিচিত্র ছাই–কেন না তা কাঠের নয়, কয়লার নয়, এমনকী কাগজেরও নয়।
যকের ধন প্রাপ্তির আশা নিয়ে ছাইয়ের গাদা খোঁচাতে শুরু করল ইন্দ্রনাথ রুদ্র এবং কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই বিচিত্র ভস্মস্তূপের মধ্যে আবিষ্কৃত হল বিচিত্রতর দশটি বস্তু।
অদ্ভুত দশটি বস্তু। ছাইয়ের গাদায় থেকে তারা ভস্মাচ্ছাদিত। তবুও চিনতে অসুবিধে হল না। আটটা চ্যাপ্টা ঝিনুকের বোতাম আর দুটো অদ্ভুত-দর্শন ধাতব বস্তু। একটা তিনকোণা, অনেকটা চোখের আকারে। আরেকটা আঁকশির মতো। দুটোরই আকার খুব ছোট এবং দুটোই খাদ মিশানো কোনও সস্তা ধাতুতে তৈরি। আটটা ঝিনুকের বোতামের মধ্যে দুটো অপেক্ষাকৃত বড়। প্রতিটি বোতামের কিনারায় পল তোলা এবং কেন্দ্রে সুতো গলানোর চারটি ছিদ্র।
দশটি বস্তুই কিন্তু আগুনে ঝলসানো।
বিড়বিড় করে বলল জয়ন্ত–ইন্দ্রনাথ, এই দশটা জিনিস নিয়ে ভাবতে ভাবতেই আমার মাথা ধরে গেল, কিন্তু সুরাহা হল না।
নীরবে পোড়া বোতাম, তেকোণা ধাতু আর আঁকশি নাড়াচাড়া করতে করতে ইন্দ্রনাথ জিগ্যেস করলে–ফায়ারপ্লেস শেষবার কে সাফ করেছে খোঁজ নিয়েছ?
নিয়েছি। পারুলই সাফ করেছে।
কখন?
আজ সকালে সাতটার একটু পরেই। সাতটার সময়ে একজন বোর্ডার ঘর ছেড়ে দেয়। তাই টংগু লিনচান আসার আগেই ঘর সাফ করে দেয় পারুল।
নাইট টেবিলের ওপর বোতাম, আঁকশি আর তেকোণা ধাতুটা রেখে ট্রাভেলিং ব্যাগের ভেতরে দৃষ্টিনিক্ষেপ করল ইন্দ্রনাথ। ভেতরটা অত্যন্ত অগোছালো, যাচ্ছেতাইভাবে হাঁটকানো। চারটে লম্বা নেকটাই, দুটো ধোয়া সাদা শার্ট, মোজা, আন্ডারওয়্যার আর রুমাল ঠাসা ব্যাগের মধ্যে। প্রতিটি শার্ট আর আন্ডারওয়্যারের ওপর লেবেল আঁটা একই ওস্তাগরের–ম্যাকিনস, জোহানেসবার্গ।
দেখে শুনে বন্ধুবরের খিঁচড়ে যাওয়া মেজাজটা কিঞ্চিৎ শরিফ হল বলেই মনে হল। খুশি খুশি মুখে গিয়ে দাঁড়াল ওয়ার্ডরোবের সামনে। টুইডের ট্র্যাভেলিং স্যুট, আর বাদামি রঙের একটা কোট ছাড়া ভেতরে আর কিছুই নেই।
সশব্দে পাল্লাটা বন্ধ করে ঘুরে দাঁড়াল ইন্দ্রনাথ। সঞ্চরমান দৃষ্টি স্থির হল দেরাজের ওপরে। প্রথম তাকটা শূন্য। দ্বিতীয় এবং তৃতীয় ড্রয়ার খুলেও কিছু পাওয়া গেল না।
জয়ন্ত বললে–বৃথা খুঁজছ। জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখবারও সময় দেওয়া হয়নি মিঃ লিনচানকে। উঁহু, টেবিলেও কিছু নেই। যা আছে তা বাথরুমেই।
যেন এই কথাটুকুর জন্যেই অপেক্ষা করছিল কবিতা। জয়ন্তর কথা ফুরোতে না ফুরোতেই জ্যামুক্ত শায়কের মতো সাঁ করে ছুটে গেল বাথরুম লক্ষ্য করে। পেছন পেছন সমান বেগে ছিটকে গেল লম্বোদর লস্কর। অগত্যা আমিও পেছনে পড়ে থাকাটা বুদ্ধিমানের কাজ মনে করলাম না।
চৌকাঠে দাঁড়িয়ে ঠোঁটের কোণে আলগোছে একটা কাচি ঝুলিয়ে আমাদের কীর্তিকলাপ লক্ষ্য করতে লাগল ভারতের প্রথম কনসাল্টিং ডিটেকটিভ ইন্দ্রনাথ রুদ্র।
বেসিনের ওপর ভোলা রেক্সিনের টয়লেট-কিট। সাবান আর চুল লাগা আধোয়া সেফটি রেজরের পাশেই দাঁড় করানো ভিজে শেভিং বুরুশ। এক টিউব শেভিংক্রিম। ছোট্ট একটি ট্যালকম পাউডার আর এক টিউব টুথপেস্ট। কলের পাশেই গড়াগড়ি যাচ্ছে প্লাস্টিকের শেভিং বুরুশ রাখবার আধার–ঢাকনাটা পড়ে টয়লেট কিটের ওপর।
লম্বোদরবাবুর মুখটা লম্বা হয়ে গেল। নিরাশ কণ্ঠে বললে–কিসসু নেই এখানে।
আমি বললাম–সত্যিই তাই। শুধু বোঝা যাচ্ছে, দাড়ি কামানো শেষ হতে না হতেই খুন হয়ে গেছেন টংগুমশাই। সেটটা ধুয়ে রাখবারও সময় পাননি।
কবিতা কিন্তু কালো হিরের মতো ঝিকিমিকি চোখে বলল–তুমি কিগো, অন্ধ নাকি! বলেই গটগট করে বেরিয়ে গেল বাইরে। পেছনে লম্বোদর লস্কর।
বিমূঢ়ভাবে জিনিসগুলো আর একবার উল্টেপাল্টে দেখলাম। শেভিং বুরুশের ঢাকনা উল্টে দেখলাম ভেতর দিকে খাপে খাপে লাগানো এতটুকু একটা প্যাড। উল্লেখযোগ্য আর কিছুই না পেয়ে ঘুরে দাঁড়াতেই দেখলাম অপলক চোখে ঢাকনিটার দিকে তাকিয়ে ঘন ঘন সিগারেট ফুঁকছে ইন্দ্রনাথ রুদ্র।
বেডরুমে ফিরে এসে দেখি হোটেল ম্যানেজার পিটার ড্যানিয়েল হাত-মুখ নেড়ে তর্ক করছে জয়ন্তর সঙ্গে। মুখ টিপে জয়ন্ত শুনে যাচ্ছে।
পেছন পেছন ইন্দ্রনাথ এসে বললে–ব্যাপার কী? গোলমাল কীসের? চারদিকে ঢি ঢি পড়ে গেল যে। এদিকে সকাল থেকে স্টাফকে ধরে রেখেছেন আপনারা। নাইট শিফট আরম্ভ হতে চলল, বাড়ি যাওয়ার জন্য সব ছটফট করছে–আমারও সেই অবস্থা। অথচ আপনারা
মাঝপথেই ড্যানিয়েলকে থামিয়ে দিয়ে ইন্দ্রনাথ বলল–জয়ন্ত, তোমরা যা দেখবার দেখেছ। আমরাও দেখলাম। এখন আর খামোকা এঁদের হয়রান করে কোনও লাভ নেই।
অলরাইট মিঃ ড্যানিয়েল, আপনারা যেতে পারেন। বললে জয়ন্ত।
পিটার ড্যালিয়েল উধাও হতেই ইন্দ্রনাথ ফিরে দাঁড়াল আমাদের দিকে। হিরো-হিরো কায়দায় একমুখ ধোয়া ছেড়ে বললে–লম্বোদরবাবু কিছু বলবেন?