দ্বিতীয়ত স্টিপানের মৃত্যুতে লাভ হয়েছে সোভিয়েতের–খবর বেরিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আর থাকেনি। তৃতীয়ত, স্টিপান জীবিত থাকলে আমাদের যে সুবিধেগুলো ছিল–তা তিরোহিত হয়েছিল ওঁর মৃত্যুর সঙ্গে-সঙ্গে। মিঃ অ্যাভালন, এতগুলো যুক্তি শোনবার পর নিশ্চয় বলবেন না, অন্যের হাতে খুন হয়েছিলেন স্টিপান। না, না, না। গুপ্তচর যেভাবে পঞ্চত্বপ্রাপ্ত হয়–স্টিপানকেও পরলোকে যেতে হয়েছে ঠিক সেইভাবে।
আচমকা হুঁশ হল গোনজালোর, একগাদা খাবারের গুঁড়ো লেগে রয়েছে কোটের হাতায়। ঝেড়ে সাফ করতে করতে বললেন–এতদিন পরে স্টিপানের খুন নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন কেন বুঝলাম না। হেঁয়ালিটাই তো শোনা হল না এখনও। খুনি কে, এইটাই কি আপনার প্রহেলিকা?
না। খুন হলেন কেন স্টিপান–প্রহেলিকা সেইটাই।
অর্থাৎ–
মিঃ গোনজালো, স্টিপান একটা জবর খবর দেওয়ার জন্যেই ছুটে এসেছিলেন কিউবা থেকে। কিন্তু দিতে পারেননি। যদি জানতে পারতাম সেই খবর–এই দেশের ক্ষয়ক্ষতি অনেক কম হত। স্টিপানের খুনের পরেও খবরটার ধরন জানা উচিত ছিল আমাদের। এই নিয়েই ভেবেছি রিটায়ার করার আগে–ভাবি এখনও।
মিঃ পেনটিলি, বললেন হ্যাঁলস্টেড স্টিপানের খুনের পর কি আপনাকে জোর করে রিটায়ার করানো হয়েছে? কিছু মনে করবেন না আপনাকে বিড়ম্বনায় ফেলছি বলে।
না। খুনের সঙ্গে আমার অবসর নেওয়ার কোনও সম্পর্ক নেই। কোনও দুর্নাম কুড়োতে হয়নি। রিটায়ার করেছি এই তো বছর কয়েক আগে সসম্মানে–পুরস্কার নিয়েছি প্রেসিডেন্ট নিক্সনের হাত থেকে। খুনের পর একা আমিই ওপরতলাকে পইপই করে বলেছিলাম কিছু একটা জানাতে চেয়েছিলেন স্টিপান প্রাণ-প্রদীপ নিভে যাওয়ার ঠিক আগে কানে তুলো এঁটেছিল ওপরতলাপাত্তাই দেয়নি আমার মতামতে। বিপদটা ঘটেছিল তখনি। মুখে চাবি দিয়ে থাকতে বাধ্য হয়েছিলাম বটে কিন্তু মন থেকে তাড়াতে পারিনি। রিটায়ার করার পর সেই রহস্যই বড্ড বেশি পীড়া দিয়ে চলেছে আমাকে।
জবর খবরটা কীভাবে দিতে চেয়েছিল স্টিপান? গোনজালোর প্রশ্ন।
ওঁর কাছে লিখিত কিছু ছিল না–সে ব্যাপারে আমরা নিশ্চিত হয়েছিলাম মৃতদেহ দেখবার সঙ্গে-সঙ্গে। অত কঁচা কাজ করতেন না স্টিপান। লেখালেখির মধ্যে যেতেন না। হোটেল রুমে টুরিস্টের কাছে যা থাকে তার বেশি কিছু রাখেননি সঙ্গে, একটামাত্র সুটকেশ, তার মধ্যে জামাকাপড়, মাজন, বুরুশ, চিরুনি ইত্যাদি। খুব পাকা হাতে নাড়াচাড়া হয়েছে সবকিছুই কিন্তু খুনি কিছু নিয়ে গেছে–তা মনে হয়নি।
খটকা লেগেছিল শুধু দুটো জিনিস দেখে। একটা হল শব্দছকের হেঁয়ালি পুস্তক অর্ধেক হেঁয়ালি নিজের হাতে লিখে সমাধান করেছেন অথবা করবার চেষ্টা করেছেন স্টিপান–আর একটা স্ক্র্যাবল সেট যা উনি হরবখৎ রাখতেন সঙ্গে…
বাধা দিলেন রুবিন–যাতে কেউ দেখা করতে এলেই তার সঙ্গে এক হাত খেলতে পারে?
আজ্ঞে না। একা থাকলেই চার হাতের খেলা নিজে নিজে খেলতেন স্টিপান–পকেট ডিক্সনারির সাহায্য নিয়ে খেলে যেতেন নিজের মনে। শব্দসম্ভার বাড়ানোর জন্যে ওঁর প্রচেষ্টায় কঁকি ছিল না তিল মাত্র–আগেই বলেছি সেকথা। ডিক্সনারিটাও পেয়েছি ওঁর কোটের পকেটে আলমারিতে ঝোলানো ছিল কোট।
ও, বলে চুপ করে গেলেন রুবিন।
দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থাতেই ছুরি খেয়েছিলেন বলেই সঙ্গে-সঙ্গে মারা যাননি স্টিপান নিখুঁত এই অপরাধে এইটাই একমাত্র খুঁত বলতে পারেন। খুন করার পর খুনি অথবা একাধিক খুনি তড়িঘড়ি চম্পট দিয়েছিল বলেই তারপরেও ধড়ে প্রাণ নিয়ে বেঁচেছিলেন স্টিপান। টেবিলের পাশেই আছড়ে পড়েছিলেন–ঘর ফাঁকা হয়ে যেতেই উঠে দাঁড়িয়েছিলেন টেবিল ধরে। টেবিলে তখন ছিল একটা খবরের কাগজ-ওয়াশিংটন পোস্ট–আর স্ক্র্যাবল সেট।
টেনে খুলেছিলেন টেবিলের সব চাইতে ওপরের ড্রয়ার কলম বের করে লিখতে গিয়ে দেখেছিলেন কালি নেই। হোটেলের কলমের দশা এই রকমই হয়। কলম ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলেন মেঝেতে। নিজের পেন ছিল কোটের পকেটে–ঘরের আর একদিকে। অতদূর যেতে পারবেন না বুঝেছিলেন বলেই সে চেষ্টা করেননি–আয়ু ছিল মোটে মিনিট ছয়েকের মতো। তাই কাজে লাগাতে হয়েছে নাগালের মধ্যেকার জিনিসকে।
ছুরি খাওয়ার সময়ে কাগজটা ছিল ভাঁজ করা অবস্থায়–ঘণ্টাখানেক আগে সেই অবস্থাতেই কাগজ এনে রেখেছিলেন টেবিলে–
এত ব্যাপার জানলেন কী করে? হ্যাঁলস্টেডের প্রশ্ন।
পারিপার্শ্বিকের বিবেচনায়। এ ব্যাপারে অন্তত দক্ষতা আমাদের তুলনাবিহীন বলতে পারেন। টেবিলের ড্রয়ার টেনে খোলা, খটখটে শুকনো কলম গড়াগড়ি যাচ্ছে মেঝেতে। সবচেয়ে বড় কথা, ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরোচ্ছিল স্টিপানের শরীর থেকে বিশেষ করে ডান হাত থেকে ছুরির মার আটকাতে গেছিলেন ডান হাত দিয়েই। রক্তাক্ত হাত আর শরীর যেখানে যেখানে ঠেকেছে রক্তের চিহ্ন লেগেছে সেই-সেই জায়গায়।
যা বলছিলাম, স্পোর্টস্ পৃষ্ঠায় কাগজটা খুলেছিলেন স্টিপান। তারপর হাতে নিয়েছিলেন ক্র্যাবল খেলার বাক্স, টেনে সরিয়েছিলেন কাঠের ঢাকনি, টেনে বের করেছিলেন পাঁচটি হরফ, পর-পর সাজিয়েছিলেন হোল্ডারে। মারা গেছিলেন ঠিক তখুনি। হরফগুলো এই ওe, p, o, c আর k।
সাজিয়েছিল কি এইভাবেই? শুধোন ড্রেক।
হ্যাঁ। বাঁ-দিক থেকে ডানদিকে।