দু-হাত ওপরে তুললেন গোলজালো–এখনও শেষ করিনি, জিওফ। ঠিক এই কারণেই হেনরী বহুবার বহু জটিল সমস্যার সমাধন করে দিয়েছে চোখের পলক ফেলবার আগেই। আমরা যখন তলিয়ে ভাবি–
আমরা মানে আমাদের সব্বাই নয়। বাধা দিলেন রুবিন–আপনি সেই দলে থাকতে পারেন।
হেনরি তখন তা করে না রুবিনের মন্তব্য যেন শুনতেই পেলেন না গোনজালো– অপ্রাসঙ্গিক তথ্য দিয়ে মস্তিষ্ককে ভারাক্রান্ত করে না হেনরী। তাই দেখতে পায় পরিষ্কার।
খানকয়েক বাড়তি ডিস ধুতে-ধুতে হেনরী বললে মৃদু স্বরে কথার মাঝে কথা বলার জন্যে ক্ষমা করবেন, মিঃ গোনজালো। যাই করি না কেন, তা কখনওই করতে পারতাম না যদি না আপনারাই বাড়তি ব্যাপারগুলোকে বাদসাদ দিয়ে না দিতেন। আমার মাথা গুলিয়ে যায় না আপনাদের বুদ্ধিপূর্ণ আলোচনার দৌলতেই।
বিনয় বচন শেষ করে ডিস নামিয়ে রাখল হেনরী। গেলাসে গেলাসে ঢেলে গেল আর এক দফা শ্বেত মদিরা। অবিচল দক্ষতা ফুটে উঠেছে তার ষাট বছরের বলিরেখা আঁকা মুখের পরতে পরতে।
ট্রামবুল বললেন–ম্যারিও, তোমার বস্তাপচা সস্তা থিওরি নেহাতই অচল। আর হেনরী, অত বৈষ্ণব বিনয় ভালো নয়। তোমার ব্রেন আমাদের ব্রেনের চাইতে যে অনেক ধারালো–তাতে নেই কোনও সন্দেহ। তুমি নিজেও তা জানো।
স্যার, মোটেই না, হেনরীর কণ্ঠে সেই বিনয়–সবার প্রতি সশ্রদ্ধ সম্মান জানিয়ে শুধু এইটুকুই বলতে চাই–অবিসম্বাদিতকে দেখবার ক্ষমতা আমার আছে। তার কারণ একটাই–বললেন গোনজালো–আমাদের অনেকেই যা করেন–তুমি তা করো না। ঘোলানির মধ্যে দিয়েও অবিসম্বাদিতকে দেখবার সময়ে নিজের বিচার বুদ্ধিকে ঘোলাটে করে তোলো না।
বাতাসে মাথা ঠুকে নীরব সম্মতি জানিয়ে চুপ মেরে গেল হেনরী এবং অনেকটা স্বচ্ছন্দ হয়ে উঠল ক্ষুব্ধ রুবিন অন্য প্রসঙ্গে চলে যেতেই। লেখকের বিবিধ জ্ঞান অনেক সুফল ফলায়; সেই জ্ঞানকে বিশ্লেষণ করলে কত আশ্চর্য কাণ্ড ঘটে যায়; সাধারণ বুদ্ধিমত্তা মানে তো তাই মনের খাতায় তথ্যকে জমিয়ে রাখা, দরকার মতো সেই তথ্যকে কাজের মধ্যে টেনে আনা, তাকে চুলচেরা বিশ্লেষণ করা এবং প্রয়োজন হলে রকমারি স্মৃতির সংশ্লেষণ ঘটিয়ে চমকপ্রদ বিস্ময়কে সৃষ্টি করা, ইত্যাদি…
সুদীর্ঘ এবং জ্ঞানগর্ভ এই আলোচনায় কিন্তু তিলমাত্র আগ্রহ দেখালেন না প্রধান অতিথি পেনটিলি। চিন্তাঘন নিমেষহীন দৃষ্টি ফিরতে লাগল হেনরীর পেছন-পেছন…
.
প্রধান ভোজপর্ব শেষ হল। ফল মিষ্টি আহার সমাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত ধৈর্য ধরে গেলেন ট্রামবুল। কয়েক কাপ কফিও নেমে গেল বেশ কয়েকটা উদরে। কফির কাপ যখন ফের ভরতি করা হচ্ছে, তখন মুখ খুললেন ট্রামবুল। চামচে দিয়ে টং-টং করে কঁচের গেলাস বাজিয়ে ঘোষণা করলেন, এবার শুরু হোক সমস্যা সমাধান ওরফে বঁঝরিতে ঝলসানোর পালা।
বললেন গুরু গুরু গলায়–যেহেতু আমি হোস্ট, সুতরাং সমস্যা সমাধানের কষ্ট দিতে চাই মাননীয় প্রধান অতিথিকে। ম্যারিও, সুরুয়ার শুরু থেকে যন্ত্রণা দিতে শুরু করেছেন আপনি। প্রধান অতিথিকে কষ্ট দেওয়ার ভারটাও আপনি নিন।
সানন্দে নিলাম, সশব্দে কেশে গলা সাফ করলেন ম্যারিওমিঃ পেনটিলি, আপনি যে এখনও। টিকে আছেন–এটাই একটা রহস্য। কিন্তু টিকে থাকাটা ন্যায়সঙ্গত হয়েছে কিনা–তা বলুন পুত্থানুপুঙ্খভাবে।
কান এঁটো করা হাসি হাসলেন পেনটিলি। এমনই হাসি যে দুই গালের দুই উঁচু হনুর ওপর নৃত্য করে উঠল দু-দলা মাংসপিণ্ড। তখন তাকে মনে হল বড়দিনের বুড়ো সান্তাক্লজের মতো– যে সান্তাক্লজের গালে নেই সাদা দাড়ির স্রোত কিন্তু পরনে আছে আধুনিক ধড়াচূড়া।
বললেন–থ্যাঙ্ক হেভেন। আর কি তার দরকার আছে? রিটায়ার করেছি এবং তোফা আছি। যতদিন কাজে ছিলাম টিকে থাকার চেষ্টা চালিয়ে গেছি হয়তো ব্যর্থ হয়েছি।
কীভাবে সেই চেষ্টা চালিয়েছেন?
নিশ্বেস নিয়ে। টিকে থাকা যায় একমাত্র সেইভাবেই। কিন্তু আপনার প্রশ্ন তা নয়। আপনি জানতে চাইছেন, রুটি রোজগার করতাম কীভাবে–তাই তো?দেখুন মশায়, টম যেভাবে আঙ্কল স্যাম-এর সেবা করেছেন, আমিও প্রায় সেইভাবে পেটের ভাত জুটিয়েছি।
গুপ্ত সঙ্কেত-এর বিশেষজ্ঞ ছিলেন?
না না। তবে গুপ্ত সংস্থায় থাকতে হয়েছে।
টিকে থাকার পক্ষে সেটা কি ন্যায়সঙ্গত পন্থা? বলে উঠলেন রুবিন।
সবিনয় জবাবটা দিলেন পেনটিলি–তাই নিয়ে বিতর্কে প্রবেশ করতে চান?
একদম না, ঝটিতি বললেন ট্রামবুল–কোন জীবিকা ন্যায়সঙ্গত আর কোনটা নয়–এ বিষয়ে বার পঞ্চাশেক বিতর্ক হয়ে গেছে। ম্যারিও, চালিয়ে যান।
ঝুঁকে বসলেন ম্যারিও–গত ভোজসভায় প্রধান অতিথি একটা প্রহেলিকা পেশ করেছিলেন। আপনার কোনও প্রহেলিকা আছে?
এই মুহূর্তে নেই। তাই আমি মোটামুটি সুখী। টম এবং আরও অনেকে সমাধান করে দেন আমার জীবনের সমস্ত সমস্যা। আমি শুধু দেখে যাই–পর্যবেক্ষণ করা ছাড়া আর কোনও বাতিক আমার এখন নেই। তবে একটা প্রশ্ন কুরে কুরে খাচ্ছে আমার এই মনকে। যদি অনুমতি করেন– পেশ করতে পারি উপযুক্ত জবাবের প্রত্যাশায়।
বলুন।
হেনরী আমাদের ওয়েটার?
এই ক্লাবের সবচেয়ে দামি সদস্য এবং সব সেরা সদস্য, বললেন ট্রামবুল।
বেশ। শুনে মনে হল, হেনরী হেঁয়ালির জট খুলতে পোক্ত। কী ধরনের হেঁয়ালি?
অস্বস্তির ছায়া ভেসে গেল হেনরীর মুখাবয়বের ওপর দিয়ে ক্ষণেকের জন্যে। বললে–খেতে বসে মাঝেমধ্যেই নানারকম সমস্যা এসে যায় কথাবার্তার মধ্যে। মাননীয় সদস্যরাই সে সবের সুরাহা করে দেন।