একদম কথা বললেন না একজনই। জিওফ্রে অ্যাভালোন। শিরদাঁড়া সিধে করে বসে থাকা এঁর একটা বাতিক। এখনও বসে রইলনে সেইভাবে। ভুরু দুটো শুধু একটু কুঁচকে রইল। মাঝের আঙুল দিয়ে অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে নাড়তে লাগলেন সিরাজির বরফ। এই তাঁর দ্বিতীয় গেলাস।
অলরাইট, অলরাইট, বললেন গোনজালো শব্দটা যে ইংরেজি শব্দ নয়–তা মেনে নিতে কারও দ্বিধা নেই। চক্ষের নিমেষেই তা দেখা যায়। কিন্তু দেখা যায় কী করে, প্রশ্নটা সেইখানেই। ইংরেজি শব্দ যতগুলো জানা আছে তার ফিরিস্তিতে কি চোখ বুলোতে হচ্ছে? চোখ বুলোনোর পরই কী বলছেন–না, Blain শব্দটা ইংরেজিতে নেই? নাকি, শব্দটার আওয়াজটা চেনাচেনা লাগছে না বলেই আন্দাজে ঢিল ছুড়ছেন? আপনারা যদি মনে–
নরম গলায় বাধা দিলেন হ্যাঁলস্টেড।
বললেন–মানুষের স্মৃতি কাজ করে কীভাবে, কেউ যখন তা জানে না–তখন প্রশ্নটা তুলছেন কেন। স্মৃতির কলকবজা চালু রয়েছে কীভাবে, এ সম্পর্কে যাঁরা তত্ত্বের পর তত্ত্ব আউড়ে যান তারাও জানেন না কীভাবে তথ্যকে বের করে আনতে হয় মাথার মধ্যে একবার তা ঢুকিয়ে দেওয়ার পর। এই যে এতগুলো শব্দ বলে গেলাম–এদেরকে টেনে আনতে হচ্ছে আমারই শব্দের ভান্ডার থেকে–যখন যেটাকে দরকার, ঠিক তখনি পেয়ে যাচ্ছি সেই শব্দটাকেই। এ রহস্যের কিনারা কি আজও হয়েছে?
ট্রামবুল বললেনভায়া, এমন অনেক সময় আসে যখন মাথার চুল ছিঁড়ে ফেললেও যে শব্দটি যখন দরকার, তখন তাকে পাওয়া যায় না।
ঠিক এই সময়ে ক্লাবের অতুলনীয় ওয়েটার হেনরী এক বাটি কাছিমের সুরুয়া এনে রাখল হ্যাঁলস্টেডের সামনে। দেখেই চিত্ত তৃপ্ত হয়েছে হ্যাঁলস্টেড সাহেবের। লোভনীয় আহার্যর দিকে মন ধাবিত হয়েছে তুরঙ্গ বেগে। এহেন পরিবেশে কথার কচকচি মানেই মনের ওপর চাপ সৃষ্টি করা। হ্যাঁলস্টেড সাহেব আবার মানসিক চাপ একদম সইতে পারেন না। তোতলাতে থাকেন।
এ ক্ষেত্রেও তো-তো করে তিনি বললেন–বিলকুল ঠিক। ঠিক এই সময়ে ঠিক শব্দ মনে করতে না পারলেই মেজাজ আপনার খিঁচড়ে যায়। শুধু আপনার নয়, বেশির ভাগ লোকেরই তাই হয়। ভাবে বুঝি সাংঘাতিক একটা কিছু গোলমাল ঘটে গেছে সহজভাবে নিতে পারে না কিছুতেই। যেমন আমি। মনের মতো শব্দ মনে করতে না পারলেই তোতলাতে থাকি।
অ্যাভালোন-এর ভারী পুরুষালি কণ্ঠস্বর গমগমিয়ে উঠল এই সময়ে। টেবিল মাত করে দিলেন একাই।
সবুর! সবুর! Blain বলে একটা শব্দ আছে বইকি। সেকেলে হলেও ইংরেজি শব্দ। মানে, ফোঁড়া।
রাইট, হৃষ্ট কণ্ঠে বললেন গোনজালো–বাইবেলের শব্দ। বুক অফ এক্সোডাস-এ আছে। মিশরে প্লেগ মহামারীর কথা লেখার সময়ে ব্যবহার করা হয়েছে। জানতাম, কেউ না কেউ ঠিকই ধরতে পারবেন। আমি তো ভেবেছিলাম ম্যানি-র মাথায় এসে যাবে।
ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বললেন, রুবিন–আমি কিন্তু ভেবেছিলাম, একেলে ইংরেজির কথা হচ্ছে।
আমি কিন্তু তা বলিনি, বললেন গোনজালো–তাছাড়া, Blain শব্দটা Chilblain শব্দেরই অংশ এবং Chilblain একটি আধুনিক ইংরেজি শব্দ। মানেটা কারও অজানা নয়–ঠান্ডায় হাতে পায়ে ফোঁড়া হলে বলা হয় Chilblain।
কে বলেছে Chilblain একেলে ইংরেজি শব্দ? গরম হয়ে গেলেন রুবিন–তাছাড়া…
উচ্চকণ্ঠে ধমক দিলেন ট্রামবুল-ম্যানি, আত্মরক্ষার চেষ্টা করবেন না। ম্যারিও এসব কথা জানলেন কী করে, সেটা জানা আগে দরকার। ভালো কথা। আমারই বিশেষ অনুরোধে আজ সামুদ্রিক কড মাছ ফিন্যান হ্যাঁডি রান্না করা হয়েছে। যদি কারও খেতে রুচি না হয়–হেনরীকে বলে দিন অন্য পদ দিতে।–ম্যারিও, বলুন কোত্থেকে জানলেন এত ব্যাপার?
সাইকোলজির বই পড়তে গিয়ে জেনে ফেলেছি, বললেন ম্যারিও গোনজালো সবকিছু জেনেই জন্মেছি–এমন ধারণা আমার মাথায় নেই, আছে ম্যানি-র মাথায়। চোখ আর কান খোলা রেখে শিখে যাই এবং সেই জ্ঞানকে দরকার মতো কাজে লাগাই। যেমন লাগালাম এক্ষুনি। মনে রাখাটাও তো বিপজ্জনক ব্যাপার।
সে বিপদের মধ্যে আপনি অন্তত কখনও পড়বেন না, স্বগতোক্তি করলেন রুবিন।
পড়লেও বয়ে গেছে। মনে রাখার ঝকমারি তো দেখতেই পেলাম। জিগ্যেস করলাম, Blain শব্দটা ইংরেজিতে আছে কিনা–জিওফ ছাড়া ঝটপট জবাব দিয়ে গেলেন প্রত্যেকেই। জিওফ দ্বিধায় পড়লেন, কেন? কেন না, উনি বেশি মনে রাখেন। বাইবেলে এই শব্দের ব্যবহার তার মনে আছে। সেই সঙ্গে মনে আছে আরও অনেক কিছু। এত মনে রাখার ফলেই সিদ্ধান্ত নিতে তার দ্বিধা জেগেছে।
হক্ কথা, বললেন ড্রেক। এই মুহূর্তে তিনি কাঁটা চামচের ওপর একটু ফিন্যান হ্যাঁডি নিয়ে জিভে রেখেছেন। চোখ মুখ চিন্তায় আবিল হয়ে উঠেছে। পরমুহূর্তেই খুশির রোশনাই ছড়িয়ে গেল সারামুখে।
গোনজালো বললেন–এই দ্বিধাটাই খুব খারাপ। ঝটপট সিদ্ধান্ত নেওয়া এবং কাজে নেমে পড়া–এই হল গিয়ে সফলতার চাবিকাঠি। দ্বিধায় পড়ার চাইতে ঝটপট বাজে সিদ্ধান্ত নেওয়াও অনেক ভালো। অনেক ক্ষেত্রে ভালো। মানুষকে এই কারণেই ক্ষীণ স্মৃতি দেওয়া হয়েছে টিকে থাকার জন্যে।
হেসে সায় দিলেন অ্যাভালোন–খুব একটা মন্দ অভিমত নয়, ম্যারিও। কণ্ঠস্বরে প্রকাশ পেল অর্বাচীনকে প্রশ্রয় দেওয়ার সুর-তর্কবিতর্কের মধ্যেও ক্রমবিবর্তনের সুফল সম্পর্কে আমার একটা থিওরি আছে। বলেছি কী? শিকারি সমাজে..