দয়ালশঙ্করের ফরসা মুখ থেকে সমস্ত রক্ত নেমে গেছিল। আস্তে-আস্তে উনি বসে পড়লেন একটা সোফায়।
বসলেন ডি এম–তার পাশে। ইন্দ্ৰনাথ দাঁড়িয়ে রইল সামনে। চোখে যেন কমল হিরে জ্বলছে।
ঠিক এই সময়ে ঘরে ঢুকল সত্য আর কমলা।
ইন্দ্র বললে, আপনারা দুজনেই ওপরে যান মিসেস শেঠকে নিয়ে আসুন। যদি না আসতে চান–পরিচয় দেবেন নিজেদের–তাহলেই আসবেন।
দয়ালশঙ্কর রুমাল বের করে কপালের ঘাম মুছলেন। সত্যকে টেনে নিয়ে কমলা চলে গেল ওপরে। একটু পরেই হাত ধরে নিয়ে এল এক প্রৌঢ়াকে। মুখ তার এমনিতেই সাদা, বোধহয় অ্যানিমিয়ায় ভুগছেন বলে আরও সাদা মনে হচ্ছে। বিবর্ণতা বেড়ে গেছে বিষম ভয়ে। কঁপছেন। কমলা তাকে ধরে বসিয়ে দিল দয়ালশঙ্করের পাশে। ইন্দ্রনাথ দাঁড়িয়েই রইল। এক দৃষ্টে চেয়ে রয়েছে। দুজনের দিকে।
বাইরে পায়ের আওয়াজ পাওয়া গেল। ভারিক্কি চেহারার এক ভদ্রলোক ঘরে ঢুকলেন। শ্যামবর্ণ। চোখে চশমা। রোদে পোড়া মুখ। একটু বিরক্ত।
ডি এম উঠে দাঁড়ালেন, আসুন স্যার। দয়ালশঙ্করকে দেখিয়ে বললেন, এঁকে চিনতে পারছেন?
দয়ালশঙ্করের সামনে এসে দাঁড়ালেন ভদ্রলোক। ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রইলেন। বললেন, না চেনার কী আছে। অতবড় উকিল আন্দামানে আর তো কেউ ছিল না।
ডি এম বললেন, আপনি বসুন। মিঃ শেঠ উঁকিলি ব্যবসা ছেড়ে দিলেন কেন?
সেটা নিয়ে জল্পনাকল্পনা আমরাও করেছি। ওঁর বন্ধু সাত্যকি সাহা ছিলেন মস্ত বড় টিম্বার মার্চেন্ট। কাটা গুঁড়ি চাপা পড়ে একই সময়ে মারা গেলেন স্বামী-স্ত্রী দুজনেই। একমাত্র ছেলেকে নিয়ে কোথায় যে চলে গেলেন শেঠ মশাই–
কার ছেলে?
আশ্চর্য কথা। কার আবার? সাত্যকি সাহার।
স্যার, রাগ করবেন না। রাজনীতি করার দৌলতে আপনি আন্দামানের অনেকের হাঁড়ির খবর রাখেন বলেই আপনাকে বিরক্ত করছি। সেই ছেলের বয়স তখন কত ছিল?
একটু ভাবলেন ভদ্রলোক। ঘড়ি দেখলেন, নেক্সট ফ্লাইটেই আমাকে দিল্লি যেতে হবে। ছেলেটার বয়স…তা তিন বা চার বছর তো হবেই।
আপনি দেখেছিলেন?
হ্যাঁ, হ্যাঁ।
এই ছবির মতো তাকে দেখতে ছিল কি? বলে ডি এম যে ফটো এগিয়ে দিলেন, সেটা নয়নতারা-র ফাইল থেকে খুলে এনেছিল সত্য বসু।
একবার দেখেই ভদ্রলোক বললেন, মনে তো হচ্ছে তারই। অনেক বছর আগে দেখা তো। কেন বলুন তো?
স্যার, এই ছেলেটাকে পাগল সাজিয়ে পুরুলিয়ায় নয়নতারা মেন্টাল নার্সিং হোমে রাখা হয়েছিল।
অ্যাবসার্ড! এ ছেলে কক্ষনও পাগল ছিল না।
হাসপাতালও সেই রায় দিয়েছে। এই সেই ছেলে, সত্যকে দেখিয়ে বললেন ডি এম। ছবির সঙ্গে মিল খুঁজে পাচ্ছেন?
চোখ, সঙ্গে-সঙ্গে বলে উঠলেন শ্যামবর্ণ ভদ্রলোক, এবার মনে পড়েছে। ছেলেটার আশ্চর্য চোখ নিয়ে আমরা কত কথাই বলতাম সাত্যকি সাহাকে। এ সেই চোখ। এতবড় হয়েছে! এই ছেলেকে পাগল সাজানো হয়েছিল! কে সাজিয়ে ছিল? ইনি? দয়ালশঙ্করকে দেখিয়ে যেন ফেটে পড়লেন রাজনীতিবিদ। ওঁর সঙ্গেই তো ছেলে এসেছিল আন্দামান ছেড়ে।
মূলে ছিলেন ইনিই। তবে নার্সিংহোমে সত্য বসুর বাবা আর মা বলে পরিচয় দিয়েছিলেন যাঁরা, তাঁদের এই ছবি। দুটো পাশপোর্ট ফটো এগিয়ে দিলেন ডি এম, দিল্লি থেকে ইস্যু করা বার্থ সার্টিফিকেটে লাগানো ছিল ফটো দুটো।
কার বার্থ সার্টিফিকেট?
সাত্যকি সাহার এই ছেলের।
ওর জন্ম তো আন্দামানে। বাবা আর মা তো–
মিস্টার অ্যান্ড মিসেস সাত্যকি সাহা। দিল্লিতে জাল বার্থ সার্টিফিকেটের ফলাও ব্যাবসার খবর আপনি তো রাখেনই–
জঘন্য কাণ্ড চলছে।
চবিশ বছর আগেও ছিল এই জালিদের কারবার। এই ছেলের বাবা আর মা বলে পরিচয় দিয়েছিল এই দুজন। ছবি দেখলেন–এবার স্বচক্ষে দেখুন।
চোখের ইঙ্গিত করলেন ডি এম। সত্য বেরিয়ে গেল। সঙ্গে করে নিয়ে এল বাচ্চু সেন আর তার স্ত্রী-কে।
ছবির সঙ্গে মিলিয়ে নিলেন রাজনীতিবিদ, আশ্চর্য! ক্রিমিন্যাল আপনারা। সাত্যকি সাহার ছেলেকে নাম ভাড়িয়ে নিজের ছেলে বলে চালিয়েছিলেন? পাগলাগারদে রেখেছিলেন? হোয়াই? আই ওয়ান্ট টু নো, হোয়াই?
এই প্রথম কথা বললেন দয়ালশঙ্কর। এখন তার গলা শক্ত।
ভুল করছেন সকলেই। সাত্যকির ছেলে রোগে ভুগে সরকারি হাসপাতালে মারা গেছে বাইশ বছর আগে। ডেথ সার্টিফিকেট আছে।
থতিয়ে গেলেন রাজনীতিবিদ। চাইলেন ডি এম এর দিকে। ডি এম চাইলেন ইন্দ্রনাথের দিকে।
ইন্দ্রনাথ বললেন রুদ্রকণ্ঠে, মানুষ যখন ইতোর হয়, লোভী হয় তখন সে পশুরও অধম। বাচ্চু সেনের স্ত্রী আমাদের কাছে সব বলেছেন। ওঁর মুখেই শুনুন।
স্বামীর দিকে না চেয়ে বলে গেল তার স্ত্রী কলের পুতুলের মতো, পাপ আর পারা কখনও চাপা থাকে না। ফুটে বেরোবেই। আমি কত বারণ করেছিলাম। হোক সে জন্ম রুগ্ন–তবুও তো আমার ছেলে। তাকে দেওয়া হল দয়ালশঙ্কর শেঠকে আর এই ছেলেটাকে সত্যকে দেখিয়ে নিয়ে এসে সুপ্রিয় বসু আর সাধনা বসুর নাম দিয়ে জাল বার্থ সার্টিফিকেট বানিয়ে ছেলেটাকে ঢুকিয়ে দেওয়া হল পাগলাগারদে। ভগবান আছেন।
কেন? ইন্দ্রর প্রশ্ন।
কেন আবার। আমার ছেলে ছিল জন্ম রুগ্ন–সে তো মারা যেতই। কিন্তু লোকে জানত, মারা গেল সাত্যকি সাহার ছেলে। বন্ধু দয়ালশঙ্করকে দিয়ে তিনি উইল করেছিলেন তাদের অবর্তমানে ছেলের আর সম্পত্তির ভার দয়ালশঙ্করের। বিরাট সম্পত্তি হাতিয়ে নিলেন আসল মালিককে পাগল সাজিয়ে।