টংগু লিনচান মারা গেছেন এগারোটা থেকে সাড়ে এগারোটার মধ্যে। আমার মনে হয়—
জ্বলজ্বলে চোখে বলে উঠল কবিতা–তার মানে কি এই নয় যে–
ধীরে, ধীরে, বউদি। যদি কিছু মাথায় এসে থাকে, তবে তা মাথার মধ্যেই রাখো। ঝট করে সিদ্ধান্তে পৌঁছনো ভালো গোয়েন্দার লক্ষণ নয়। ব্যস, এবার তোমার ছুটি। লম্বোদরবাবু, আপনি কী দেখলেন?
কপাল কুঁচকে হাতঘড়ির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল লম্বোদরবাবু। চওড়া চামড়ার ব্যান্ডওলা পুরনো মডেলের হাতঘড়ি। তারপর বললে চিন্তাচ্ছন্ন কণ্ঠে–পুরুষের ঘড়ি। পড়ে গিয়ে ধাক্কা লাগার ফলেই কাঁটা আর নড়ছে না। চামড়ার ব্যান্ডের দ্বিতীয় গর্তে একটা খাঁজ দেখা যাচ্ছে–বা আঁটা রয়েছে এই গর্তেই। কিন্তু এছাড়াও দেখছি আরও একটা খাঁজ–আরও গভীর দাগ–তৃতীয় গর্তে
সাবাস! সাবাস লম্বোদরবাবু! তারপর?
বাঁ-হাতে ফিনকি দিয়ে রক্ত পড়েছিল–সে রক্ত এখন শুকিয়ে গেছে। বাঁ-হাতের তালুতেও রক্ত লেগেছিল–কিন্তু দাগটা অনেক আবছা, যেন রক্তমাখা তালু দিয়ে কিছু আঁকড়ে ধরেছিলেন টংগু লিনচান, তাই বেশির ভাগই মুছে গেছে তালু থেকে। একটু খুঁজলেই এই ঘরেই পাওয়া যাবে জিনিসটা–টংগু লিনচানের হাতের ছাপও রয়েছে তাতে।
লম্বোদরবাবু, আপনার মতো অ্যাপ্রেন্টিস পাওয়ায় আমি গর্বিত। ওহে, জয়ন্ত, রক্তমাখা হাতের ছাপ লাগা কিছু পেয়েছ ধারে কাছে?
জয়ন্তর মুখের হাসি মিলিয়ে গেছিল। তীক্ষ্ণচোখে বলল–এক্সেলেন্ট। কিন্তু রক্তের দাগ লাগা সে-রকম কিছু তো পাইনি। কার্পেটেও তেমন ছাপ নেই। খুব সম্ভব হত্যাকারী তা সঙ্গে করেই নিয়ে গেছে।
কপাল কুঁচকে ইন্দ্রনাথ বলল–তুমি পরীক্ষক, পরীক্ষার্থী নয়। কাজেই আর ইঙ্গিত দিও না। মৃগ, তোমার কিছু বলার আছে?
তাড়াতাড়ি বললাম–মাথার ক্ষত দেখে মনে হচ্ছে ভারী কিছু দিয়ে বেশ কয়েকবার চোট মারা হয়েছে। বিছানার চাদরের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে ধস্তাধস্তিও হয়েছিল। আর মুখটা
বটে! বটে! বটে! মুখটাও লক্ষ্য করে ফেলেছ? বলো দেখি কি দেখছ?
সদ্য দাড়ি গোঁফ কামানো। গালে আর চিবুকে এখনও লেগে রয়েছে ট্যালকম পাউডার। বাথরুমটায় চোখ বুলোলে হত না?
কাচুমাচু মুখে কবিতা বললে–মুখটা আমিও লক্ষ্য করেছিলাম ঠাকুরপো। কিন্তু কথাই বলতে দিল না…পাউডারটা লাগানো হয়েছে মসৃণভাবে। কোথাও বেশি, কোথাও কম নয়।
লাফিয়ে উঠে বলল ইন্দ্রনাথ-বউদি, তোমার শার্লক হোমস্ হওয়া রোখে কে। জয়ন্ত, অস্ত্র পাওয়া গেছে?
পাথরের ভারী হাতুড়ি। এক্সপার্টের মতে, আফ্রিকান কিউরিও। বেজায় ভারী, কিন্তু এবড়ো খেবড়ো পাথর। খুব সম্ভব টংগু লিনচানের ব্যাগের মধ্যেই ছিল হাতুড়িটা–ট্রাঙ্ক তো এখনো এয়ারপোর্ট থেকে এসে পৌঁছয়নি।
ইন্দ্রনাথ আর কিছু বলল না। আনমনা চোখে তাকিয়ে রইল শয্যার দিকে। রেক্সিনের ট্র্যাভেলিং ব্যাগটা খাটের ওপরেই বসানো ছিল। পাশেই চারকোল গ্রে কালারের ইভনিং স্যুট–পরিপাটি ভাবে ভাঁজ করা কোট আর ট্রাউজার্স। সাদা শার্ট। হাতের বোতাম। সাদা সিল্কের রুমাল। খাটের তলায় দুজোড়া কালো বুট। এত জিনিস দেখেও যেন সন্তুষ্ট হতে পারল না ইন্দ্রনাথ। বার বার চোখ বুলোতে লাগল ঘরের অন্যান্য জিনিসগুলোর ওপর। অশান্ত চোখ। যেন কিছু একটা খচ খচ করছে বুকের মধ্যে। খাটের পাশেই চেয়ারে পড়ে একটা ময়লা শার্ট, একজোড়া ময়লা মোজা, ময়লা গেঞ্জি আর আন্ডারওয়্যার–কিন্তু রক্তের ছিটেফোঁটাও নেই ময়লা জামা কাপড়ে। চিন্তান্বিত ললাটে কার্পেটের দিকে তাকিয়ে রইল ইন্দ্রনাথ।
জয়ন্ত বললে–হাতুড়িটা আমরা নিয়ে গেছি। রক্তে আর চুলে মাখামাখি হয়েছিল বলেই এক্সপার্টরা..আঙুলের ছাপ কিন্তু কোথাও পাওয়া যায়নি। যেখানে খুশি হাত দিতে পারো। সব কিছুরই ছবি তোলা হয়ে গেছে, আঙুলের ছাপও খোঁজা হয়েছে।
নিরুত্তরে একটা কাচি ধরাল ইন্দ্রনাথ। আমি আর লম্বোদরবাবু হাঁটু গেড়ে বসে পড়লাম মৃতব্যক্তির পাশে। দুজনেরই উদ্দেশ্য রিস্টওয়াচটা আরো ভালোভাবে দেখা। কবিতা দেখলাম আঠার মতো লেগে রয়েছে ইন্দ্রনাথের পেছনে।
লম্বোদরের উৎসাহ একটু বেশি। তাই ঝটিতি কব্জি থেকে ঘড়িটা খুলে নিয়ে খুটখাট শুরু করে দিলে পেছনের ডালাটা নিয়ে এবং কি কৌশলে জানি না অচিরেই খুট করে খুলে ফেললে ডালাটা। সঙ্গে সঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল সোল্লাসে–পেয়েছি! পেয়েছি!
ডালার পেছনে খানিকটা সাদা কাগজের ছিন্ন অংশ আঠা দিয়ে সাঁটা। যেন কিছু একটা টান মেরে ছিঁড়ে নেওয়া হয়েছে সেখান থেকে।
তড়াক করে লাফিয়ে উঠে বললে লম্বোদরবাবু–একটা আইডিয়া মাথায় এসেছে। বলেই একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল টংগু লিনচানের নিষ্প্রাণ মুখের দিকে। সন্ধানী চোখে কি যেন খুঁজতে লাগল।
মৃগ তুমি? বলল ইন্দ্রনাথ।
ইন্দ্রনাথের মেস থেকে বেরুবার সময় তাক থেকে ওরই আতসকাঁচটা নিয়ে এসেছিলাম। এখন তা বার করে ঘড়িটা উল্টেপাল্টে দেখতে দেখতে বললাম–এখন কিছুই বলব না। তবে ঘড়িটা আমার বন্ধুর ল্যাবরেটরিতে নিয়ে গিয়ে পরীক্ষা করার অনুমতি দিলে ভালো হয়।
ইন্দ্রনাথ জয়ন্তর দিকে তাকাতেই জয়ন্ত ঘাড় নেড়ে সায় দিলে। ইন্দ্রনাথ বললে–নিতে পারো। জয়ন্ত, ঘর, ফায়ারপ্লেস, বাথরুম–সমস্ত তন্ন তন্ন করে সার্চ করা হয়েছে কি?