না থেকেও উপায় ছিল না। কেননা ঘরের মধ্যে যে দৃশ্য দেখলাম, তা দেখামাত্র শিরশির করে উঠল আপাদমস্তক।
পুরু কার্পেটের ওপর মুখ থুবড়ে পড়ে এক ব্যক্তি। দু-হাত ছড়ানো দুপাশে–সাঁতারুর মতো। কে যেন এক বালতি লাল রং ঢেলে দিয়ে গেছে মাথার ওপর…লাল রং জমাট বেঁধেছে কালো চুলে…গড়িয়ে এসেছে ঘাড় বেয়ে।
নিষ্প্রাণ নিস্পন্দ দেহটির দিকে দেখলাম বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে লম্বোদয় লস্কর।
আর কবিতা? মৃত ব্যক্তির পাশে রক্ষিত শয্যার সাদা চাদরের চাইতেও বুঝি সাদা হয়ে গেছে তার মুখ। রক্তহীন। রংহীন।
এ হেন বীভৎস দৃশ্যের প্রতিক্রিয়া নিশ্চয় আমার মুখেও দেখা গিয়েছিল। তাই আমাদের তিনজনের মুখের ওপর দৃষ্টি বুলিয়ে নিয়ে বিলক্ষণ হৃষ্টচিত্তে বলল ইন্দ্রনাথ রুদ্র–বন্ধু জয়ন্ত, নাম-ধামগুলো এবার বলে ফেলো দিকি।
নাম, টংগু লিনচান। বয়স বিয়াল্লিশ। বার্মিজ খ্রিস্টান। বিয়ে হয়েছিল কলকাতায়। স্ত্রীর সঙ্গে ডাইভোর্স হয়েছে বছর দুই আগে। রিপ্রেজেন্টেটিভ। মালিকের চাল আর কাঠের কারবার আছে মান্দালয়ে। বছরখানেক সাউথ আফ্রিকায় ছিলেন। নেটিভদের মারধোর করায় বিতাড়িত হয়েছেন ব্রিটিশ আফ্রিকা থেকে। রাঁদেভু হোটেলে নাম লিখিয়েছেন হপ্তা খানেক আগে। দিন তিনেকের জন্যে ঢাকায় গিয়েছিলেন আত্মীয়ের সঙ্গে দেখা করতে। আজ সকালেই ফিরেছেন। সাড়ে নটার সময়ে হোটেলে ঢুকেছেন। বারোটা পাঁচে মরে পড়ে থাকতে দেখেছে পারুল।
পারুল কে? প্রশ্ন করে ইন্দ্রনাথ।
ঝি। মানে, ঘরদোর ঝটপাট দেয়।
টংগু লিনচানের আগের ইতিহাস?
খুব অল্পই পাওয়া গেছে। মিশুকে। সামাজিক। যদূর জানা গেছে, শত্রু নেই। আফ্রিকা থেকে যে জাহাজে ফিরেছেন, সে জাহাজেও শত্রু সৃষ্টির মতো কিছু করেননি। তবে হ্যাঁ, টংগু লিনচান নাম্বার ওয়ান লেডি কিলার। বউকে ডাইভোর্স করার আগে থেকেই লটঘট ছিল একটা মেয়ের সঙ্গে। কারবারের নাম করে নাকি তাকে নিয়েই পালিয়েছিলেন আফ্রিকায়। ফেরবার সময়ে ভদ্রমহিলাকে ফেলে এসেছেন। কলকাতাতেও তার এক প্রেয়সী আছে।
কাকে সন্দেহ হয়?
চিন্তাচ্ছন্ন চোখে বর্মী পর্যটকদের মৃতদেহর দিকে তাকিয়ে বলল জয়ন্ত–আজ সকালেই টংগু লিনচানের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল তার কলকাতার প্রেয়সী। নাম, ভায়োলেট অ্যালক্যাটরা। ভায়োলট চাকরি বাকরি করে না–অথচ ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের ফ্ল্যাটে রানির হালে থাকে। টংগু যখন ঢাকায়, তখন একবার এসে খোঁজ করে গেছিল ভায়োলেট। এনকোয়ারী কাউন্টারে খোঁজ নিয়ে জেনেছিল আজ সকালেই মিঃ লিনচানের ফেরার কথা। তাই ভায়োলেট এসেছিল এগোরোটা পাঁচে। রুম নাম্বার নীচ থেকে নিয়ে লিফটে করে উঠেছিল তিন তলায়। কখন বেরিয়ে গেছে কেউ জানে । দরজায় টোকা মেরে কারো সাড়া না পেয়ে চলে যায় ভায়োলেট। বাইরেও অপেক্ষা করেনি। টংগু লিনচানের সঙ্গে নাকি তার দেখাও হয়নি।
ঠিক এই সময়ে মৃতদেহের চুলের ডগা থেকে নখের ডগা পর্যন্ত তীক্ষ্ণদৃষ্টি বুলিয়ে নিয়ে খাটের কিনারায় বসে পড়ল কবিতা।
সবিস্ময়ে লক্ষ্য করলাম চাপা উল্লাসের রোশনাই ওর তমালকালো দুই চোখে। তবে কি…তবে কি সূত্রের সন্ধান পেয়েছে কবিতা?
নিরীহ কণ্ঠে বলল ইন্দ্রনাথ–পা টন্ করছে বুঝি? কর্ণপাত না করে জয়ন্তকে জিগ্যেস করল কবিতা–বউ কী বলে?
বউ? টংগু যে আফ্রিকা থেকে ফিরে এসেছেন, তাই নাকি সে জানে না–দেখা হওয়া তো দূরের কথা। সকালে চৌরঙ্গিতে গেছিল সিনেমার টিকিট কিনতে।
গিন্নির তৎপরতায় আমার জড়তাও অন্তর্ধান করেছিল। জয়ন্তর কথা শুনতে শুনতে সন্ধানী চোখ বুলোচ্ছিলাম ঘরের এ-কোণ থেকে সে-কোণে–হঠাৎ পাওয়া কোনও সূত্রের আশায়।
ঘরটা আর পাঁচটা প্রথম শ্রেণির হোটেল ঘরের মতোই। বৈশিষ্ট্যহীন। সিঙ্গলবেড। ওয়ার্ডরোব। কাঁচের দেরাজ। নাইট টেবিল। চিঠি লেখার ডে। আর চেয়ার। স্রেফ ঘর সাজানোর জন্যে ডামি ফায়ারপ্লেস।–ওপরের তাকে টাইমপিস আর একারি বিভিন্ন স্বাদের ইংরেজি নভেল।
মৃতদেহের পাশে নতজানু হয়ে বসে পড়ল ইন্দ্রনাথ। ঘাড়খানা সারস পাখির মতো বাড়িয়ে ঝুঁকে পড়ল লম্বোদয়। তাই দেখে চেয়ারে বসতে বসতে ফিক করে হেসে ফেলল জয়ন্ত চৌধুরী।
মৃতদেহটাকে চিৎ করে শুইয়ে দিল ইন্দ্রনাথ। রাইগর মার্টিসে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ তখন আড়ষ্ট হয়ে উঠেছে। হিমকঠিন দেহ আর পোশাকের ওপর দ্রুত হাত চালিয়ে নিয়ে বলল–বউদি, মৃগ, লম্বোদরবাবু। শুরু করা যাক এবার। বউদি, তুমিই আগে বলো। বলো কী দেখেছ?
টপ করে খাট থেকে লাফ দিয়ে নেমে এল কবি। বোঁ করে এক চক্কর ঘুরে এল লাশটাকে।
ইন্দ্রনাথ সকৌতুকে বললে–ব্যাপার কী? এখনও কিছু চোখে পড়ল না? এতদিন কি বৃথাই গপপো শোনালাম তোমাকে?
লাল ঠোঁটে টুক করে জিভ বুলিয়ে নিয়ে রুদ্ধশ্বাসে বললে কবিতা–দেখছি পুরোদস্তুর বিলিতি পোশাক পরার অভ্যেস টংগু লিনচানের। পায়ে কার্পেট স্লিপার। আর হ্যাঁ–সিল্কের আন্ডারওয়্যার।
ঠিক, ঠিক। এ ছাড়াও আছে কালো সিল্কের মোজা আর গার্টার। কোট-প্যান্টে ওস্তাগরের নামও রয়েছে–ম্যাকিনসন্স, জোহানেসবার্গ। আর কী?
বাঁ-হাতে একটা রিস্টওয়াচ। আর…আর ঘড়ির কঁচটা চিড় খেয়ে গেছে। কাটা আর ঘুরছে না। দাঁড়িয়ে গেছে ১১-৫০ মিনিটের ঘরে।
চমকার! চমৎকার! জয়ন্ত, ডাক্তার কী বলে?