কবিতার কথার সুরে কী যেন ছিল। জাদু বোধহয় একেই বলে। ঘরকুণো বাঙালি আমরা। কিন্তু অ্যাডভেঞ্চারের নেশা কেন আমাদের রক্তে, এ প্রশ্নের জবাব পাই না। থর মরুভূমির দিকে তাকিয়ে ভাসা ভাসা দুটি চোখে দুর-দিগন্তের ছবি দুলিয়ে কবিতা যা বলল, তা যেন আমাদেরই মনের কথা। আমরা যেন একই সুরে একই গান গেয়ে উঠলাম। সমস্বরে বললাম-তাই ভালো। চল যাই।
এলাম স্টেশনের কাছে। উটের আড্ডা সেখানে। সেইসঙ্গে জিপ আর মোটরসাইকেল। অপরূপা কবিতার দুইপাশে দুই বঙ্গ-তনয় দেখে ছেকে ধরল ড্রাইভাররা। ওদের অনর্গল কথা থেকে এইটুকু বুঝলাম যে বাবুরা শুটিংয়ের জন্যে মরুভূমি দেখতে যাবেন তো? ফার্স্টক্লাস জিপ দেব, চলে আসুন। শুনলাম, শুটিং এখানে হামেশাই হচ্ছে। বিশেষ করে সত্যজিৎ রায় তাঁর গোপী গায়েন বাঘা বায়েন-এর কিছু দৃশ্যগ্রহণ করতে এ অঞ্চলে এসেছিলেন। তারপর থেকেই বেঙ্গলিবাবু দেখলেই আর রক্ষে নেই।
অত কথায় আমরা আর গেলাম না। শুধোলাম–উট আছে?
হাঁ করে তাকিয়ে রইল ওরা।
কবিতা এবার ওর দুর্গাপ্রতিমার মতো বড় বড় দুই চোখ পাকিয়ে ঝঙ্কার দিল–হাঁ করে দেখবার কি আছে? বলি, উট আছে?
উট? এমনভাবে ওরা সাড়া দিল যেন উট জিনিসটা প্রাগৈতিহাসিক জন্তু–এ যুগে দুর্লভ। ডাইনোসর বা টেরোড্যাকটিস-এর মতো উট প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলাও নিরাপদ নয়। একজন তো বলেই বসল–উট কি হবে? উটের পিঠ একতলা উঁচু। পড়ে মরবেন নাকি? হাড়গোড় গুঁড়িয়ে যাবে যে।
কবিতা গেল ক্ষেপে–তাতে তোমার কী? আমরা উট চাই। উটের পিঠে চাপব, মরি মরব। তিনটে উট চাই। সারাদিনের জন্যে।
ওরা অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে রইল। দু-একজন নিজেদের মধ্যে ফিসফাসও করে নিল। তারপর শুনলাম, উট নামক জীবটা নাকি ইদানীং বিকানীরে বড়ই দুর্লভ হয়ে দাঁড়িয়েছে। চাইলেই তা পাওয়া যায় না। সবুর করতে হবে।
রাগে গজগজ করতে করতে আমরা ফিরে এলাম হোটেলে। কবিতা যদি নাগিনী হত, তাহলে নিশ্চয় আসবার সময় ছোবল বসিয়ে আসত উটের আড্ডায় কাউকে না কাউকে। কিন্তু কিছুই যখন করা গেল না, তখন আমরা গেলাম বিকানীর প্যালেসে। সেখানে পাথরের চত্বরে দাঁড়িয়ে নীচের শহরের দিকে তাকিয়ে আছি, দেখছি সাদা সাদা ঘিঞ্জি বাড়ির চেহারা আর ভাবছি সব দেশীয় রাজ্যেই কি একই দৃশ্য? চকমিলানো মার্বেল প্রাসাদ একজনের, ঝুঁকো বাড়ি সকলের?
এমন সময়ে কবিতা বলল–ঠাকুরপো, বললে তো বলবে মেয়েদের মনে সন্দেহ লেগেই আছে। কিন্তু সেই সকাল থেকে একটা লোক আমাদের পিছু নিয়েছে। লোকটা এখানেও এসেছে।
কবিতা কথাটা বলল যেন হাওয়াকে লক্ষ্য করে নীচের ঘিঞ্জি বাড়ির দিকে তাকিয়ে। ইন্দ্রনাথও কথাটা শুনল যেন হাওয়ার মুখে। দুজনের কেউই পিছন ফিরল না, এদিক ওদিক তাকাল না। অগত্যা আমিও যেভাবে দাঁড়িয়েছিলাম, রইলাম সেইভাবেই দাঁড়িয়ে।
ইন্দ্রনাথ বলল–যদি কেউ পেছনে লেগে থাকে তো তোমার জন্যে।
অপরাধ?
তোমার উর্বশীরূপ। বিদেশ-বিভুয়ে বেরিয়ে রূপটাকে ঢেকে রাখলেই পার।
তুমি গোয়েন্দা না কচু। |||||||||| কেন?
চোখ থাকতেও চোখ নেই। মেয়েদের এইজন্যই গোয়েন্দা হওয়া উচিত।
খুলে বল।
আমরা সোজা চলি। সোজা দেখি। কিন্তু পাশ থেকে কে আমাদের দেখে কী করছে, না তাকিয়েও বুঝতে পারি। যেমন এখন পেরেছি।
সে তো ভালো কথা। কিন্তু সে জন্যে আমি গোয়েন্দা না হয়ে কচু হতে যাব কেন?
যাবে এই কারণে যে লোকটা কার দিকে তাকিয়ে আছে তা তুমি দ্যাখনি–কিন্তু আমি দেখেছি।
কার দিকে তাকিয়ে?
তোমার দিকে।
ইন্দ্রনাথ কোনও জবাব দিল না। পকেট থেকে চন্দনকাঠের কাজ-করা সিগারেট কে বার করল। একটা সিগারেট ঠোঁটের ফাঁকে আলগোছে ঝুলিয়ে নিয়ে কি যেন ভাবতে লাগল। তারপর দেশলাই বার করে জ্বালতে গিয়ে কাঠি নিভে গেল। হাওয়া বোধহয় সামনে থেকে আসছে। তাই পেছন ফিরে হাত আড়াল করে কাঠি জ্বালতেই জ্বলে উঠল। সিগারেটও জ্বলল।
আমি দেখলাম, আঙুলের ফাঁক দিয়ে সেইসঙ্গে অদূরে মার্বেল ক্যানোপির কাছে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটাকেও দেখা হয়ে গেল ইন্দ্রনাথের।
কাঠিটা ফেলে দিয়ে ঘুরে দাঁড়াল ইন্দ্রনাথ।
বলল–বউদিকে ধন্যবাদ জানাই। আমার নাম কচু হওয়াই উচিত। লোকটা আমাকেই নজরে রেখেছে।
কিন্তু কেন? শুধোলাম আমি।
বুঝতে পারছি না। আমরা তিনজনেই এ অঞ্চলে বিদেশি। অথচ নজর আমার দিকে। তার মানে একটাই। লোকটা আমাকে চেনে। আমি কিন্তু ওকে চিনতে পারছি না।
এই পর্যন্ত কথা হল বিকানীর প্যালেসে। এবার ফেরার পালা। মনটা আর ততটা হালকা নয়। রোমাঞ্চ-রোমাঞ্চ ভাবের সঙ্গে একটু দুর্ভাবনা তো আছেই। রাজপুতদের দেশে এসে না জানি কি ঝামেলায় পড়তে হয়।
হলও তাই। এঁকাবেঁকা পথে ফিরছে আমাদের অটোরিক্সা। মানে, তিনচাকার মোটর সাইকেল। আচমকা রাস্তার ওপর ডিনামাইট ফাটল।
পরে শুনেছিলাম, রাস্তা চওড়া করার জন্যে অমন ডিনামাইট নাকি হামেশাই ফাটছে শহরে। কখনো ফাটাচ্ছে মিলিটারি, কখনো অন্য কর্তৃপক্ষ। কিন্তু সেদিনের ডিনামাইটটি কার দয়ায় সমস্ত রাস্তা জুড়ে ফাটল, সে হদিশ আর পাওয়া গেল না।
ফল হল সাঙ্ঘাতিক। বেগে ছুটছিল মোটরসাইকেল রিকশা, আচম্বিতে সামনে দেখলাম রাস্তা উড়ে গেল। তিনতলা বাড়ির সমান ধুলো আর ধোঁয়ার ফোয়ারা লাফিয়ে উঠল।