বাইরের বিস্ময়বিহ্বল দৃশ্য দেখার লোভ সম্বরণ করতে পারল না কার্পেন্টার। তাই জানলা দিয়ে উঁকি মারতেই কালি পটকার স্তূপে আগুন লাগার মতো প্রচণ্ড শব্দে এক ঝাঁক পুলিশের গুলি ছুটে এল তাকে লক্ষ্য করে। সাঁৎ করে কার্পেন্টার আড়ালে সরে এল বটে, কিন্তু টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়ল সার্সির কাঁচ আর ঝাঁঝরা হয়ে গেল কাঠের ফ্রেম। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই স্কোয়াড অফিসাররা ঢুকে পড়ল বাড়ির মধ্যে।
মেঝের ওপর বসেছিল কার্পেন্টার। পুলিশ অফিসারদের রণমূর্তি দেখেই নিরীহ নাগরিকদের মতোই বলে উঠল–আমি না, আমি না, আমাকে আপনাদের দরকার নেই। আমি তো এইখানেই থাকি।
কিন্তু এ ধোঁকাবাজিতে ভোলবার পাত্র নয় অফিসার। হিড়িহিড় করে সিঁড়ির ওপর দিয়ে ওকে টেনে নামিয়ে আনা হলে নীচে। একবার তো ফস্ করে রিভলভারটা বার করে ফেলেছিল আর কি! তবে তাতে সুবিধা করা গেল না। রাস্তায় টেনে নামানোর পরও মানুষ-নেকড়ের মতোই ও প্রাণপণে ধস্তাধস্তি করতে থাকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার। হইহই করে এগিয়ে এল মারমুখো জনতা। আর সে কি চিৎকার–মারুন, মারুন, খুন করে ফেলুন খুনে ছুঁচোটাকে!
ঠেলেঠুলে পুলিশের গাড়িতে তুলে দিলাম ওকে, মিনিট কয়েক পরেই চার্জরুমে দেহতল্লাস করা হল ওর। পাওয়া গেল এই কটা জিনিস : দুটো রিভলভার, ছটা ৩৮ কার্তুজ, এক প্যাকেট অ্যাসপিরিন, হাতঘড়ি, পাঁচটা চাবি, দুটো পাঁচ ডলারের নোট আর খুচরো আটটা সেন্ট।
বিচার শুরু হলে কার্পেন্টারের হাত-পা বেঁধে এবং কোমরবন্ধনীর সঙ্গে পুরু চামড়ার ফিতে লাগিয়ে আদালতে নিয়ে যাওয়া হল তাকে। বড় বিশ্রী দেখাচ্ছিল ওকে দাড়ি না কামানোর জন্যে আর চুল না আঁচড়ানোর জন্যে। শুনানির সময়ে আগাগোড়া একজন আত্মীয়ার সঙ্গে কথা কইল কার্পেন্টার। স্টেট প্রসিকিউটর জোর গলায় বললেন, রিচার্ড কার্পেন্টার আইনত সুস্থ মস্তিষ্ক। বেশ কয়েকজন মনোসমীক্ষককে ডেকে তিনি প্রমাণ করে দিলেন কোনটা ন্যায় আর কোনটা অন্যায়, তা বোঝার টনটনে জ্ঞান আছে তার। কৌসিলীর সঙ্গে সহযোগিতা করার মতো বুদ্ধিবিবেচনারও অভাব নেই।
আর তাই, ডিটেকটিভ উইলিয়াম মর্ফিকে হত্যার অপরাধে ১৯৫৬ সালের ১৬ মার্চ আদুরে খোক পুলিশ-হন্তা রিচার্ড ডি কার্পেন্টারকে ইলেকট্রিক চেয়ারে বসিয়ে মৃত্যুদণ্ডের রায় দেওয়া হল শুনে কেউই অবাক হননি।
* জন ফ্লানেগান (শিকাগো, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র) রচিত কাহিনি অবলম্বনেও।
আফিং ও ইন্দ্রনাথ রুদ্র
ইন্দ্রনাথ রুদ্রকে অনেক অপকর্মের নাড়ীনক্ষত্র জানতে হয়েছে, কারণ সে প্রাইভেট ডিটেকটিভ। তা সত্ত্বেও একটি কেস নিয়ে নাজেহাল হয়েছিল ইন্দ্রনাথ। হওয়াটা আশ্চর্য নয়। কেন না, এত জেনেও যা নিয়ে কোনওদিন মাথা ঘামাতে হয়নি তাকে, চাঞ্চল্যকর এই মামলার মূল রহস্য ছিল সেইটাই। আমি আফিংয়ের চোরাই কারবারের কথা বলছি।
বড়দিনের সময়ে সাধারণত আমরা কলকাতায় থাকি না। শীতের আমেজ গায়ে লাগলেই মনটা উড়ুউড়ু হতে থাকে। বড়দিনের কটা দিন কোথাও না কোথাও কাটিয়ে আসি। একা কখনো যাই না। গৃহিণী কবিতা সঙ্গে তো থাকেই। সেই সঙ্গে বন্ধুবর ইন্দ্রনাথ রুদ্র।
বছর কয়েক আগে এমনি একটা বড়দিন কাটাতে আমরা এসেছিলাম রাজস্থানে। মরুভূমির শীতের একটা আলাদা আমেজ আছে। ধু-ধু বালির দিকে তাকিয়ে মনটাও কেন যেন হু-হুঁ করে ওঠে। আমার গিন্নি বলে, তুমি নির্ঘাত আরব বেদুইন ছিলে গত জন্মে। আমি ওর থুতনি নেড়ে বলতাম–আর তুমি ছিলে বেদুইন বউ?।
ইন্দ্রনাথ অমনি গলাখাঁকারি দিত পেছন থেকে। বলত–ওহে কপোত-কপোতী, তোমাদের দস্যুবৃত্তির মধ্যে আমি কিন্তু ছিলাম না।
মুখ টিপে হেসে কবিতা বলত–তুমি দস্যু নও, তুমি তস্কর। রমণীকুলের চিত্ত লোপাট করতে অদ্বিতীয়।
ছেলেমানুষ হয়ে যেতাম তিনজনেই। মরুভূমি আমাদের সব ভুলিয়ে দিত। আমরা ভুলে যেতাম আমাদের শিষ্টাচারের আড়ষ্টতা, ভুলে যেতাম কথা বলার ঠাটবাট। সহজ হয়ে যেতাম অন্তর পর্যন্ত। ফলে যে ধরনের ইয়ার্কি-ঠাট্টায় মত্ত হতাম, তা নিষ্পাপ মনেই করতাম।
দিনরাত পাপী-তাপীদের নিয়ে ঘেঁটে ঘেঁটে ইন্দ্রনাথ নিজেও চাইত সব কিছু ভুলে যেতে। কিন্তু এমনই কপাল, কোনওবারেই তা সম্ভব হত না। একটা না একটা ভজকট ব্যাপার এসে জুটতই। যেমন হল সেবার–রাজস্থানে।
বিকানীরে গিয়ে আমরা মরুভূমির রুখু চেহারা দেখে কবিতার পর কবিতা আওড়াচ্ছিলাম, ইন্দ্রনাথ ওর কবি-কবি চেহারা নিয়ে বসে থাকত বালিয়াড়ির ওপর। হাওয়ায় চুল উড়ত। টানা-টানা স্বপ্নালু দুটি চোখে ও কিসের স্বপ্ন দেখত, তা ভগবানই জানেন। দেখে আমার মনটা কীরকম হয়ে যেত। ব্যাচেলর হলেই কি অমনি হয়? আমিও এককালে ব্যাচেলার ছিলাম। বম্বের কোটিপতি কন্যার পাণিপীড়ন করার আগে আমিও নিঃসঙ্গ ছিলাম। কিন্তু ইন্দ্রনাথের একাকীত্বের জাত আলাদা। ওর মনের নাগাল পাওয়ার ক্ষমতা বোধকরি কোনও নারীরই নেই। তাই ও চিরকুমারই রয়ে গেল।
সেদিন হঠাৎ কবিতা বায়না ধরল, ঠাকুরপো চল উটে চড়ি।
চড়ে? ভুরু কোচকালো ইন্দ্রনাথ।
মরুভূমির ভেতর পর্যন্ত চলে যাব। যেখানে মোটরসাইকেল যায় না, জিপ যায় না–সেইখানে চলবে আমাদের উট খপখপ করে। আমরা উটের পিঠে বসে দুলব আর দুলব। গলা ছেড়ে গান গাইব। বালিয়াড়ির ঢেউ দেখব। ফণিমনসা আর কাটাঝোঁপ গুণব। সূর্যাস্তের রঙ মনে গেঁথে নেব। তারপর আবার ফিরবে আমাদের উট খপখপ করে বালির টিলা পেরিয়ে। ভালো লাগবে না?