একটির পর একটি ঘণ্টা কাটতে থাকে। আরও গুমোট হয়ে উঠতে থাকে ছোট্ট ঘরটা। রিভলভারটা হাতেই রেখেছিল কার্পেন্টার। ঘুম-ঘুম চোখেও সজাগ রেখেছিল দৃষ্টি। ঘুমের দাপটে চোখ দুটো একেবারেই বন্ধ না হয়ে যায় সেজন্যে সারারাত সে কি প্রানান্তকর প্রচেষ্টা তার!
পরের দিন ভোরবেলা লিওনার্ড বললে–আমাকে কাজে বেরুতে হবে। না বেরুলে কোম্পানি আর পাড়াপড়শীরা অনেক প্রশ্ন করতে পারে। অপলক চোখে লিওনার্ডের মুখের দিকে তাকিয়ে কার্পেন্টার শুধু বললে–যাচ্ছেন যান, কিন্তু মনে রাখবেন বাড়িতে রইল আপনার স্ত্রী আর দুই ছেলেমেয়ে। আমি যদি আপনি হতাম, তাহলে এরকম পরিস্থিতিতে আহাম্মকের মতো কিছুই করতাম না। বুঝেছেন?
লিওনার্ড বুঝেছিল। সাড়ে ছটার সময়ে বেরিয়ে গেল সে। রাত্রেই তো আপদ বিদেয় বাড়ি থেকে। সঙ্গে সঙ্গে পুলিশে ফোন করলেই চলবে খন। ওইটুকু সময়ের মধ্যে বেশি পথ আর যেতে হচ্ছে না বাছাধনকে। লাঞ্চ খাওয়ার অবসরে স্ত্রীকে ফোন করল লিওনার্ড সব শান্ত। কোনও হাঙ্গামা নেই।
দিনের বেলা কয়েক ঘণ্টা ঘুমিয়ে নিল কার্পেন্টার। ঘুম থেকে উঠে এক পেট খেয়েও নিল। তারপর গোঁফটা কামিয়ে ফেলে মুখ পরিষ্কার করে ফেলল। মিসেস পাওয়েলের ভয়ার্ত মুখচ্ছবি দেখে নিশ্চিন্ত ছিল কার্পেন্টার। নিদারুণ আতঙ্কে এমনই অন্তর-কঁপুনি শুরু হয়েছিল তার যে কোনওরকম বিপদের সম্ভাবনাই ছিল না ওদিক থেকে। সেইদিনই বিকেলে মিসেস পাওয়েলের মা এল মেয়ের সঙ্গে দেখা করতে। এই সময়টা ছেলেমেয়েদের শোবার ঘরে ঘাপটি মেরে রইল কার্পেন্টার।
দারুণ উদ্বিগ্ন মন নিয়ে কাজ থেকে ফিরে এল লিওনার্ড। সঙ্গে এনেছিল সেইদিনকার দৈনিকের সর্বশেষ সংস্করণ! কাগজটা ছিনিয়ে নিল কার্পেন্টার। তারপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল নিজের সম্বন্ধে টাটকা সংবাদ জানার আগ্রহে। আর তখনই অবস্থায় গুরুত্ব উপলব্ধি করে বলে উঠল ও–অন্ততপক্ষে আরও দুদিন এ জায়গা ছেড়ে বেরোনো চলবে না। এখানে থাকার জন্যে আপনাদের খরচপত্রও আমি পরে পুষিয়ে দেব কিছু টাকা পাঠিয়ে।
ডিনার তৈরি করে ডাক দিল মিসেস পাওয়েল। কিন্তু অচেনা লোকের সঙ্গে এক টেবিলে বসে খেতে ছেলেমেয়েরা অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করায় কালো আঙুর আর শাকসজীভরা প্লেটটা নিয়ে সামনের ঘরে উঠে এল কার্পেন্টার। ইতিমধ্যে খেতে খেতে ফিসফাস করে কি শলাপরামর্শ করে নিল পাওয়েল দম্পতি। তার পরেই লিওনার্ড উঠে গেল অন্য ঘরে কার্পেন্টারের কাছে। গিয়ে বললে যে তার ছেলেমেয়েদের একটা নিয়মিত অভ্যাস আছে। প্রতিদিন রাত্রে বাড়ির সামনে গিয়ে ওরা মা আর দাদু-দিদিমার সঙ্গে কিছুক্ষণ বসে থাকে। সে রাতেও ওদের যাওয়া দরকার। দুই কঁধ ঝাঁকিয়ে অনুমতি দিল কার্পেন্টার।
কিছুক্ষণ পরে লিওনার্ড বলে উঠল–এই যাঃ, ভুলেই গিয়েছিলাম। শ্বশুরের সঙ্গে ব্যবসা সংক্রান্ত কিছু কথা কইবো বলেছিলাম। আমারই যাওয়া দরকার নীচে। তা না হলে উনি নিজেই উঠে আসবেন।
কার্পেন্টার বললেন,–অত কথায় কাজ কি। ঠিক দশ মিনিটের মধ্যে আপনার ফিরে আসা চাই। ভুলে যাবেন না আপনার স্ত্রী আর ছেলেমেয়েরা আমার রিভলভারের পাল্লার মধ্যেই রয়েছে।
ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে এল লিওনার্ড। পরক্ষণে গোটা কয়েক লম্বা লাফে পেছনের সিঁড়ি দিয়ে বাড়ির পেছনে এসে ইঙ্গিতে স্ত্রীকে ডেকে বলে দিল ছেলেমেয়ে আর তার বাবা-মাকে নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নিয়ে যেতে। ঠিক এইরকমটিই আশা করছিল মিসেস পাওয়েল। তারপর কী করা উচিত তা তাকে না বললেও চলত। রাস্তায় বেরিয়ে পড়ল লিওনার্ড। ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে ছুটতে খেলায় মগ্ন ছেলেমেয়েদের চিৎকার করে সাবধান করে দিলে–পালাও এক্ষুণি–বন্দুক নিয়ে আসছে একটা খুনে গুন্ডা।
ঠিক নটা বেজে এক মিনিটের সময়ে টেলিফোন পেলাম লিওনার্ড পাওয়েলের। ডিটেকটিভদের চিফ ফ্রাঙ্ক ও সুলিভ্যান টেলিফোন পেয়ে ছোট্ট করে বললেন লিওনার্ডকে–গ্যাট হয়ে বসে থাকুন। আমরা আসছি। তৎক্ষণাৎ বেতার বার্তা চলে গেল তিরিশটা পুলিশের গাড়িতে। প্রত্যেকেই চতুর্দিক থেকে এগিয়ে আসতে লাগল পাওয়ালের ফ্ল্যাটের দিকে। কয়েক মিনিট পরেই সার্জেন্ট মিকলাজ-এর গলা শুনলাম :
কার্পেন্টার…কার্পেন্টার…ওপরে হাত তুলে বেরিয়ে এসো। বাড়ি ঘেরাও করে ফেলেছি আমরা। সরে পড়ার কোনও সুযোগই নেই।
জানলার সামনে আবির্ভূত হল কার্পেন্টার। দড়াম করে সার্জেন্টের দিকে গুলিবর্ষণ করেই সাঁৎ করে সরে গেল আড়ালে।
মিকলাজ এবার চিৎকার করে হুশিয়ার করে দিলে বাড়ির অন্যান্য বাসিন্দাদের। সবাই যেন মেঝের ওপর শুয়ে পড়েন–পুলিশ গুলিবর্ষণ শুরু করবে কার্পেন্টারের ওপর। ইতিমধ্যে প্রায় হাজার দুয়েক উৎসুক লোক দাঁড়িয়ে গিয়েছিল রাস্তার ওপর। সবার সামনেই আবার কার্পেন্টার দেখিয়ে দিয়ে গেল তার অসমসাহসিকতা আর অবিশ্বাস্য ক্ষিপ্রতা। পাওয়েলদের জানলা থেকে আচম্বিতে সে লাফিয়ে উঠল শূন্যপথে–চার ফুট দূরেই ছিল পাশের বাড়ির জানলাটা। জনতা এবং পুলিশ কিছু বোঝবার আগেই দারুণ শব্দে খোলা জানলাটার ওপর আছড়ে পড়ল সে। ঝনঝন করে ভেঙে পড়ল সার্সির কাঁচ, অক্ষত রইল না তার মুখ আর হাত। চক্ষের নিমেষে ঘরের মধ্যে সেঁধিয়ে গেল কার্পেন্টার। ঘরের মধ্যে যে কজন ছিল, তারা তো ভয়ে কাঠ হয়ে প্রায় মিশে গেল দেওয়ালের সঙ্গে। কোনও দিকে না তাকিয়ে এক দৌড়ে ফ্ল্যাট ছেড়ে বেরিয়ে পড়ল ও। সেখান থেকে সিঁড়ি টপকে পৌঁছোল আর এক ফ্ল্যাটে। মূর্তিমান বিভীষিকার মতো রিচার্ড কার্পেন্টারকে ধেয়ে আসতে দেখে সে ঘরের বাসিন্দারা আগেই উধাও হয়েছিল।