নীরবে মাথা হেলিয়ে লিওনার্ড জানালে, হ্যাঁ, সে জানে।
এইমাত্র আরও একজন পুলিশের লোককে গুলি করে এলাম আমি। আমি যা বলি, তা যদি করেন তো কোনও ক্ষতি হবে না আপনার। আর তা যদি না করেন, যদি দরজাটা খুলতে না চান–এইখান থেকেই আপনাকে গুলি করব আমি। খুলে দিন দরজাটা।
কয়েক মাস আগে মদ্যশালায় পুলিশ কর্মী বসাকির যে রিভলভারটা পকেটস্থ করেছিল কার্পেন্টার, সেইটাই অকম্পিত হাতে উঁচিয়ে ধরে সে লিওনার্ডের দিকে।
স্বর শুনেই রান্নাঘরে ছুটে এসেছিল মিসেস পাওয়েল। খুব ধীরস্থিরভাবে সংক্ষেপে বলে উঠল লিওনার্ড–ডার্লিং, উত্তেজিত হয়ো না। এরই নাম কার্পেন্টার। ও বলছে, ওর কথামতো কাজ করলে ও গুলি করবে না। আমাদের কোনও ক্ষতিই হবে না। চেঁচিও না।
অন্য ঘরে টেলিভিশন সেটটা চালিয়ে দিল ববি। কথা বলার শব্দ কানে আসতেই সচকিত হয়ে ওঠে কার্পেন্টার। সুধোয়–ওঘরে কে?
আমাদের দুই ছেলেমেয়ে। ববি এখন টেলিভিশন দেখছে। কিন্তু এখুনি এ-ঘরে আসবে ও শুভরাত্রি জানাতে। পিস্তলটা পকেটে রাখলে ভালো করতেন। ওকে বুঝিয়ে বলব-খন আমাদেরই বন্ধু আপনি। ও তা বিশ্বাস করবে। গণ্ডগোলও করবে না। কিন্তু রিভলভার দেখিয়ে ভয় পাইয়ে দিলে হয়তো ও চেঁচিয়ে কান্নাকাটি করতে পারে।
ববি ঘরে ঢুকতেই রিভলবার আড়ালে সরিয়ে রাখল কার্পেন্টার। মদে জড়ানো গলায় আস্তে আস্তে কয়েকটি কথাও বলল তার সঙ্গে। কোনও কিছু সন্দেহ না করে শুতে চলে গেল ববি।
পর পর দু-গেলাস জল খেল কার্পেন্টার। তারপর মিসেস পাওয়েলকে হুকুম করলে ক্ষতস্থান বাঁধার জন্যে একটা ব্যান্ডেজ নিয়ে আসতে। লিওনার্ড নিজে থেকেই ওষুধের দোকানে গিয়ে বীজবারক (অ্যান্টিসেপটিক) কিনে আনতে চাইল। কিন্তু কার্পেন্টার বড় হুঁশিয়ার। বাড়ি ছেড়ে বেরোনো তো দূরের কথা, একটু বেচাল দেখলেই ভয়ংকর পরিণতির সম্ভাবনাটা সঙ্গে সঙ্গে স্মরণ করিয়ে দিলে সে।
এরপর ট্রাউডার খুলে ফেলে আহত ঊরুর ওপর ব্যান্ডেজ বাঁধলে কার্পেন্টার। কের-এর প্রথম বুলেটটা মাংসর মধ্যে দিয়ে গেলেও দ্বিতীয় বুলেটটা গা ঘেঁষে বেরিয়ে গেছে–এতটুকু আঁচড়ও লাগেনি। মিসেস পাওয়েলকে দিয়ে টোস্ট আর কফি তৈরি করিয়ে আনল ও। কিন্তু খেল খুব অল্পই।
ক্ষুগ্নিবৃত্তি এবং ক্ষতস্থান শুশ্রষার পর লিভিংরুমে গিয়ে পাওয়েল দম্পতির সঙ্গে টেলিভিশন দেখতে বসল কার্পেন্টার। প্রোগ্রাম বন্ধ করে বিস্তারিতভাবে তার সর্বশেষ কীর্তির বুলেটিন প্রচারিত হওয়ার সময়ে নেকড়ের মতো দাঁত বের করে হি-হি করে হেসে উঠল কার্পেন্টার।
ট্রাক চালানোই লিওনার্ড পাওয়েলের পেশা। ছ-ফুট চার ইঞ্চি উঁচু বিশাল শরীরে শক্তি বড় কম নেই। ওজনও কার্পেন্টারের চাইতে কম করে ষাট পাউন্ড বেশি। কিন্তু খুনে কার্পেন্টারের মন তো নয়–যেন একটা শক্তিশালী রাডার যন্ত্র। রাডার-মন দিয়ে পাওয়েলের চিন্তাশক্তি আঁচ করে নিয়ে প্রাকুটি করে চিবিয়ে সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন–ও চেষ্টা করবেন না। বউ আর বাচ্চাগুলোর কথা মনে রাখবেন সবসময়ে।
দেহের প্রতিটি তন্তুতে নিঃসীম ক্লান্তির গুরুভার নামলেও রীতিমতো হুঁশিয়ার রইল কার্পেন্টার। অনেকক্ষণ পরে পাওয়েল বললে এবার ঘরের আলো নিভিয়ে দেওয়া দরকার। তা না হলে প্রতিবেশীদের সন্দেহ হতে পারে। খড়খড়ির পাখিগুলো নামিয়ে দিতে হুকুম করল কার্পেন্টার। জানলার আর আলোর ওপরেও আবরণ টেনে দেওয়া হল তার নির্দেশে। দেখতে দেখতে ভ্যাপসা গরমে উনুনের মতোই তপ্ত হয়ে উঠল ঘরটা।
বহুদূর থেকে ভেসে আসছিল পুলিশ সাইরেনের তীক্ষ্ণ তীব্র শব্দ–আশপাশের অঞ্চল তন্নতন্ন করে খুঁজছিল ওরা। যেন নিজের সঙ্গেই নিজে কথা বলছে, এমনিভাবে বিড়বিড় করে ওঠে কার্পেন্টার–আমার সম্বন্ধে খুব বেশি মাথা ঘামাবেন না আপনারা। শুধু এইটুকুই জানিয়ে রাখতে চাই, প্রথম গুলিটা আমি ছুঁড়িনি। যাকগে, ও নিয়ে আর এখন ভেবে লাভ কি।
তন্ময় হয়ে টেলিভিশন শুনতে লাগল কার্পেন্টার। কের তখনও জীবিত ছিল কিনা, সেই খবরই জানার জন্যেই কানখাড়া করে বসে রইল অনেকক্ষণ। তারপর বলল–শুধু একটি দুঃখ রয়ে গেল আমার জীবনে। এমন কোনও কাজ করে গেলাম না যার জন্যে আমার মা আর বোনেরা গর্ববোধ করতে পারে। অত্যন্ত নোংরা আর উদ্ধৃঙ্খল জীবনযাপন করেছি আমি। কিন্তু এখন বড় দেরি হয়ে গেছে। হয় ওই টিকটিকিগুলোর গুলিতে আমাকে মরতে হবে, আর না হলে ইলেকট্রিক চেয়ার তো রয়েছেই। মরবার আগে অন্তত একবারের জন্য মাকে দেখতে পেলে অনেকটা শান্তি পাব আমি।
বন্ধুর মতোই সমবেদনার সুরে বলে লিওনার্ড–চেষ্টা করলে আমার তো মনে হয় অনেক ভালো থাকতে পারতে তুমি, সবার ভালোবাসাও পেতে। তোমার বর্তমান হাল দেখে, এত কষ্ট দেখে, বাস্তবিকই দুঃখ হচ্ছে আমার।
সঠিক মনোবিদ্যা প্রয়োগ করেছিল লিওনার্ড। সমবেদনার স্নিগ্ধ ছোঁয়া পেলেই সবকিছু ভুলে যেত কার্পেন্টার। এ ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হল না। সঙ্গে সঙ্গে উচ্ছ্বসিত স্বরে বলে উঠল–আজ সারারাত এখানেই থাকব আমি। কাল রাতও থাকব। অন্ধকার হলে তবে বেরুব। ততক্ষণে টিকটিকিগুলো নিশ্চয় এ অঞ্চল ছেড়ে অন্য অঞ্চলে যাবে আমাকে খুঁজতে।
ছেলেমেয়েদের শোবার ঘরে ঘুমোবার ইচ্ছে ছিল কার্পেন্টারের। সেক্ষেত্রে তার রক্ষণাবেক্ষণের ভারটা থাকত নাকি ওদের ওপরেই। কিন্তু মায়ের মন কেঁপে উঠল তাতে। মরিয়া হয়ে এই বলে বোঝালে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলে ছোটমেয়ে অচেনা মুখ দেখে চেঁচিয়ে কেঁদে উঠতে পারে। তাহলেই মহাবিপদ। যুক্তিটা মনে ধরল কার্পেন্টারের। কাজেই বদ্ধ ঘরে পাওয়েল দম্পতির সঙ্গেই রাত কাটানোর আয়োজন করল ও।