নিজের চরকায় তেল দিন। ঘুম জড়ানো স্বরে উত্তর এল তখুনি।
আমি পুলিশ অফিসার। লবিতে আসুন আমার সঙ্গে।
ধীর পদে উঠে এল কার্পেন্টার। এমনভাবে এল, যেন তখনও পুরোপুরি ভাবে জেগে ওঠেনি ও। এক হাতে রিভলভার আর এক হাতে ব্যাগ নিয়ে সজাগ হয়ে রইলেন ক্লারেন্স।
ঘুম-ঘুম স্বরে আবার বলে ওঠে কার্পেন্টার–বাইরে বড় গরম, তাই ঠান্ডায় বসে একটু জিরিয়ে নিচ্ছিলাম। বে-আইনী কিছু তো করিনি।
লবিতে প্রবেশ করে দুজনে। ঠিক এই সময়ে হোঁচট খাওয়ার ভান করেই রিভলভার বার করে সোজা ক্লারেন্সের বুকের ওপর গুলিবর্ষণ করলে কার্পেন্টার। ক্লারেন্সও পাল্টা গুলিবর্ষণ করলেন বটে, কিন্তু গুলিটা লাগল পলায়মান কার্পেন্টারের পায়ে। তিরবেগে ও ছুটে গেল জরুরি অবস্থায় বাইরে বেরোনোর দরজার দিকে। আড়াইশো লোক বসা থাকলেও তখনও বেশ অন্ধকার বিরাজ করছিল সিনেমা হলেন মধ্যে। পটাপট শব্দে জ্বলে উঠল আলোগুলো কিন্তু আবার পাঁকাল মাছের মতোই হাত ফস্কে অদৃশ্য হয়ে গেল রিচার্ড কার্পেন্টার।
গুলি ছোঁড়ার আওয়াজ শুনেই লবির দিকে ছুটে গেলেন ক্লারেন্সের স্ত্রী। রাস্তা দিয়ে একজন যাজক যাচ্ছিলেন–ফায়ারিংয়ের শব্দে তিনিও বিলক্ষণ আঁতকে উঠেছিলেন। আসবার সময়ে তাঁকেই হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে এলেন ক্লারেন্স পত্নী। এসে দেখলেন টমাস ব্র্যান্ড নামে একজন মেডিক্যাল ছাত্র প্রাথমিক শুশ্রূষা করার পর চেষ্টা করছেন কেরের বুক থেকে ফিনকি দিয়ে ছুটে আসা রক্তস্রোত বন্ধ করতে। ক্লারেন্সের চেতনা তখন বিলুপ্ত প্রায়। সেই অবস্থাতেই দুর্বোধ্য ভাবে বিড়বিড় করে চলেছেন–কার্পেন্টার…কার্পেন্টার..আমি চিনেছি ওকে, কার্পেন্টার…।
সেন্ট মেরী অফ নাজারেথ হাসপাতালে পুরো পাঁচ ঘণ্টা অপারেশন টেবিলে শুইয়ে রাখা হল ক্লারেন্স কের-কে। শিকাগোর সবচেয়ে নামকরা বুক আর হৃদযন্ত্র অস্ত্রোপচারক ডক্টর এডোয়ার্ড এ অ্যাভারী দুরূহ অস্ত্রোপচার করে জীবনরক্ষা করলেন ক্লারেন্সের। অত্যন্ত পল্কা সুতোর ওপর ঝুলছিল তার জীবন। কেননা হৃদযন্ত্রের কাছেই একটা ধমনী জখম হয়েছিল গুরুতরভাবে। পরে ডক্টর অ্যাভারী আমাদের বলেছিলেন–হৃৎপিণ্ডের স্পন্দনই নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছে কের-কে। বুক ফুঁড়ে বুলেটটা বেরিয়ে যাওয়ার সময়ে সঙ্কুচিত হয়েছিল ওর হৃদয়যন্ত্র। তা না হয়ে যদি প্রসারিত হয়ে থাকত, তাহলেই কিনারা কেটে বেরিয়ে যেত গুলিটা–সেক্ষেত্রে ওর মৃত্যু ছিল অবধারিত। কিন্তু এখন আর কোনও ভয় নেই।
কার্পেন্টারের এই সর্বশেষ পাশবিক কুকীর্তির খবর ফলাও আকারে ছড়িয়ে পড়ল খবরের কাগজ, টেলিভিশন আর রেডিও মাধ্যমে। সে যে কোথায় ঘাপটি মেরে বসে রয়েছে, সে সম্বন্ধেও মন্তব্য করতে ছাড়ল না খবর পরিবেশকরা। কিন্তু এই একটিমাত্র সমস্যার সমাধান করতে গিয়েই পুলিশ হিমসিম খেয়ে গেল! কোন কোটরে যে সেঁধিয়েছে আহত কার্পেন্টার, তার কোনও হদিশই পেল না পুলিশমহল। জখম অবস্থায় গাড়ি না নিয়ে বেশি দূর যাওয়া কার্পেন্টারের পক্ষে সম্ভব নয় নিয়ে। সেইজন্যেই আশা ছিল এবার জনসাধারণের পূর্ণ সহযোগিতা পাওয়া যাবে। তাছাড়া, কম করে ষাটটা পুলিশ স্কোয়াডকেও মোতায়েন করা হয়েছিল খুনে বন্দুকবাজকে পাকড়াও করার জন্যে। প্রতিটি হাসপাতালে খবর চলে গিয়েছিল–যে-কোনও মুহূর্তে ক্ষতস্থান চিকিৎসার জন্যে কার্পেন্টারের আগমন ঘটতে পারে। রেলপথ আর বাস স্টপেজেও তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রেখেছিল গোয়েন্দারা। আজে-বাজে লোকের কাছ থেকে টেলিফোন মারফত কয়েকটা লোমহর্ষক গল্পও শুনলাম। তারা নাকি স্বচক্ষে দেখেছে রাস্তার অন্যদিক দিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ছুটে চলেছে খুনে কার্পেন্টার। কেউ কেউ তাকে লুকিয়ে থাকতে দেখেছে বিশেষ কোনও ফ্ল্যাটে অথবা দোকানের মধ্যে। সে নাকি নতুন একপ্রস্থ পোশাক কেনবার চেষ্টা করছে, লেক মিচিগানের নৌকোয় তাকে নাকি উঠতে দেখা গেছে, এবং নিশ্চিন্তভাবে সে-ই নাকি একটা মালবাহী গাড়ি থেকে লাফিয়ে নেমে পড়েছে–এমনও দেখা গেছে। জনা ছয়েক তরুণকে হাতকড়া লাগিয়ে টেনে আনল পুলিশ। কিন্তু কার্পেন্টারের সঙ্গে তাদের মুখের কোনওরকম সাদৃশ্যই পাওয়া গেল না। একজন আঁতকে উঠে হন্তদন্ত হয়ে খবর আনলে একটা সিনেমাবাড়ির ছাদে নাকি খুনেটাকে দেখতে পেয়েছে সে। সঙ্গে সঙ্গে স্কোয়াডের অফিসাররা বাড়িটা ঘেরাও করে তল্লাশী করলে তন্নতন্ন করে। পরিশেষে ছাদের ওপর পাওয়া গেল শুধু দুজন অর্ধ বসনা তরুণীকে–রৌদ্র-সুখ উপভোগ করছিল তারা।
এ হেন গদ্যময় পরিস্থিতিতে কার্পেন্টার গ্রেপ্তার হলে বাস্তবিকই ক্লাইমাক্স থেকে বঞ্চিত হত এই চমকপ্রদ কাহিনি। কিন্তু এরপর যা ঘটল, তাকে হলিউডি রীতি ছাড়া আর কিছু বলা চলে না–অলীক উপন্যাস যেন চাঞ্চল্যকর বাস্তবে রূপান্তরিত হল। যে রাত্রে সিনেমার মধ্যে পুলিশকর্মী ক্লারেন্স কের গুলিবিদ্ধ হলেন, ঠিক সেই রাত থেকেই বিচিত্র এই কাহিনির মধ্যে জড়িয়ে পড়ল একটা অতি সাধারণ মার্কিন পরিবার–ট্রাক-ড্রাইভার লিওনার্ড পাওয়েল, তার বউ আর সাত বছরের ছেলে রবার্ট আর তিন বছরের মেয়ে ডায়ানা। ওয়েষ্ট পোটোমাক অ্যাভিন্যুতে এদের নিবাস।
সেই রাতেই উৎসব ছিল পাওয়েলের বাড়িতে। সাড়ম্বরে ডিনারের আয়োজন করেছিল পাওয়েল তার নবম বিবাহ বছরে পদার্পণ উপলক্ষ্যে। বন্ধুবান্ধব আত্মীয়স্বজন নিয়ে ফুর্তিতে উচ্ছল হয়েছিল তারা রাত দশটা পঁচিশ মিনিট পর্যন্ত। অতিথিরা যখন বিদায় নিলে, তখন পাওয়েলের ছোট মেয়ে অকাতরে ঘুমোচ্ছে, আর ছেলে অন্য ঘরে বসে টেলিভিশন দেখছে। দারুণ গরম পড়েছিল সে রাত্রে–গাছের পাতা নড়ানোর মতো হাওয়াও বইছিল না। রান্নাঘরে গিয়েছিল লিওনার্ড রেফ্রিজারেটর থেকে কোল্ড ড্রিংক বার করার জন্যে, এমন সময়ে পর্দা লাগানো দরজায় টোকা মারার শব্দ শুনতে পেল ও! সামনেই দাঁড়িয়েছিল রিভলভার হাতে রিচার্ড কার্পেন্টার। লিওনার্ড ওর দিকে ফিরতেই তুহিন-শীতল স্বরে বলল–জানেন তো আমি কে?