রিচার্ড কার্পেন্টারের পরিবারের সবাই ভাবলে ছেলেটির এত মানসিক অশান্তির মূল কারণ হল পুলিশের হয়রানি আর আদালতের সমবেদনার অভাব। ১৯৫৩ সালের ডিসেম্বর মাসের চার তারিখে আর একবার স্বরূপ প্রকাশ করে ফেলল কার্পেন্টার। একটা মোটর চুরি করল ও। পরে প্রায় ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল গাড়িটা ওরই হাতে। একটা মুদিখানায় হানা দিয়ে লুঠ করল একশো ডলার। এই ঘটনার পর থেকে আর কোনওদিন সে ফিরে আসেনি নিজের বাড়িতে। পরিবারের কারোর সঙ্গেও আর দেখা করেনি। পালিয়ে পালিয়ে বেড়াতে লাগল কার্পেন্টার। পায়ে তার ক্রেপসোলের জুতো। বেল্টে গোঁজা একজোড়া রিভলভার। পরপর দুঃসাহসিক রাহাজানির এক ভয়ঙ্কর তালিকার সূচনা কিন্তু এই ঘটনা দিয়েই শুরু।
পুরো আঠারো মাস সবার চোখে ধুলো দিয়ে গা-ঢাকা দিয়ে রইল রিচার্ড কার্পেন্টার। পুলিশ মহলের প্রত্যেকেই তখন খুঁজছে ওকে। তারপর এল ১৯৫৫ সালের আগস্টের সেই শোকাবহ দিনটি। আমার বন্ধু আর সহকর্মী ডিটেকটিভ মর্কি বাড়ি থেকে হেডকোয়ার্টার আসছিল মাটির তলার রেলে চেপে। ডাকাতির তদন্ত করাই ছিল চশমাচোখে মর্ফির একমাত্র কাজ। কার্পেন্টারের রাহাজানি সম্পর্কিত সবকটা স্টাফ মিটিংয়ে হাজির ছিল মর্ফি। কাজেই চলন্ত ট্রেনে বন্দুকধারী ছোকরাকে দেখে চিনতে ভুল হয়নি ওর। তৎক্ষণাৎ লম্বা লম্বা পা ফেলে রিচার্ডকে গ্রেপ্তার করে ফেলে ও। রুজভেল্ট রোড আর স্টেট স্ট্রিটের প্ল্যাটফর্মে কার্পেন্টারকে নিয়ে নেমে পড়ে মর্ফি। তারপর এক অসতর্ক মুহূর্তে পকেট থেকে কার্পেন্টারের ফোটোগ্রাফ বার করে যখন আসল লোকটার সঙ্গে মিলিয়ে নিতে ব্যস্ত, ঠিক তখনই রিভলভার বার করে এক গুলিতেই মর্ফিকে খতম করে দিলে কার্পেন্টার। ফোটোগ্রাফ গিয়ে পড়ল মেঝের ওপর। উদ্যত রিভলভারের সামনে ভয়চকিত জনতাকে স্থাণুর মতো দাঁড় করিয়ে রেখে ও গিয়ে উঠে পড়ল একটা মস্ত গাড়ির মধ্যে সাবওয়ে থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পথ দিয়েই বাইরে যাচ্ছিল গাড়িটা। দরজা খুলেই ভেতরে উঠে পড়ে কার্পেন্টার। বিদ্যুৎ গতিতে আবার কার্তুজ ভরে নেয় রিভলভারে। এবং পরক্ষণেই ড্রাইভারকে লক্ষ্য করে নলচেটা স্থির করে রেখে গর্জে ওঠে চাপা কণ্ঠে–এইমাত্র কয়েকজনকে খুন করে এলাম আমি। চেঁচামেচি না করে গাড়িটা না চালিয়ে গেলে আপনাকেও খুন করব আমি।
গাড়িটা চালাচ্ছিলেন তেষট্টি বছরের বুড়ো মিঃ চার্লস এ কোপার। কার্পেন্টারের বজ্রগর্ভ হুমকি শুনেই আঁতকে উঠে প্রাণ হাতে নিয়ে বায়ুবেগে গাড়ি চালালেন তিনি। দেখতে দেখতে পৌঁছে। গেলেন শিকাগোর সবচেয়ে সরগরম স্থান লুপ, ডিয়ারবর্ণ আর ম্যাডিসন স্ট্রিটের কেন্দ্রে। একলাফে গাড়ি থেকে নেমেই উল্কাবেগে উধাও হয়ে গেল কার্পেন্টার।
প্রথমেই যে পুলিশ প্রহরীটির সঙ্গে দেখা হল, তার কাছেই হাউ হাউ করে কোর্পার সাড়ম্বরে বর্ণনা করলেন এইমাত্র কি ভয়ঙ্কর ঘটনাটা ঘটে গেল। আঙুলের ছাপের বিশেষজ্ঞ এসে কোপারের গাড়ি থেকে উদ্ধার করলেন তালু আর তিনটে আঙুলের ছাপ। কার্পেন্টারের ছাপের সঙ্গেই তা হুবহু মিলে গেল।
পুলিশ অফিসারকে নিকেশ করেছে কার্পেন্টার। কাজেই পুলিশ ফোর্সের প্রত্যেকে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করলে তার পায়ে বেড়ি পরানোর। যেভাবেই হোক ফাঁদে ফেলতে হবে কার্পেন্টারকে, কিন্তু প্রতিজ্ঞা করা যত সহজ, তাকে পূরণ করা ততটা সহজ নয়। একটা বাড়তি সূত্র অবশ্য পেয়েছিলাম। মিঃ কোপারের কাছে শুনেছিলাম হানাদার লোকটার মুখটা নাকি রোদে পোড়া তামাটে রঙের–প্রায় কালোই বলা চলে। স্থির করলাম, লেক মিচিগানে বেলাভূমিতে যে-কটা সমুদ্রস্নানের স্থান আছে, সবকটাতেই একবার আমার যাওয়া দরকার। এ যেন অন্ধকারে ঢিল ছোঁড়া, লাগলেও লেগে যেতে পারে।
কিন্তু কিছুই হল না। চাঞ্চল্যকর গল্পে বোঝাই রইল খবরের কাগজের পাতাগুলো। আমাদের কাছেও এল এন্তার মিথ্যা সংবাদ। শিকাগোর একটি সংবাদপত্র পাঁচ হাজার ডলার পুরস্কার ঘোষণা করে বসল। এমনকী সাহায্য করার জন্যে এফ. বি. আই. (Fedral Bureau of Investigation) কয়েকজন এজেন্টকেও পাঠিয়ে দিলে আমাদের দপ্তরে। সবই হল। কিন্তু কার্পেন্টারের টিকি দেখা গেল না কোথাও।
ডিটেকটিভ মর্ষি নিহত হওয়ার তিনদিন পর পুলিশকর্মী ক্লারেন্স কের ছেলেমেয়েদের বাড়িতে রেখে বউকে নিয়ে সিনেমা দেখতে গিয়েছিলেন একটা শীতাতপনিয়ন্ত্রিত হলে। মজার ব্যাপার কী জানেন? যে ছবিটা দেখতে গিয়েছিলেন ক্লারেন্স কের, তার নামও কিন্তু কল মি লাকি।
সিনেমা হলে ঢুকেই ক্লারেন্স-এর চোখ পড়ল একটা লোকের ওপর। পেছনের সারিতে নাক ডাকিয়ে অকাতরে ঘুমোচ্ছিল লোকটা। এক নজরেই রিচার্ড কার্পেন্টারকে চিনতে পেরেছিলেন ক্লারেন্স। গোলমাল না করে বউকে বললেন, গাড়িতে ফিরে তার জন্যে অপেক্ষা করতে।
ইতস্তত করতে লাগলেন তার স্ত্রী। তার ইচ্ছে ছিল ফোন করে পুলিশ ফৌজ ডেকে আনা। কিন্তু ক্লারেন্সের সেই এক গোঁ–কাজটা যখন আমারই আওতায় পড়ছে, তখন আমি একাই সামলাতে পারব তা।
মাত্র বছরখানেক হল পুলিশ ফোর্সে যোগদান করেছিলেন ক্লারেন্স। নবাগত তিনি, অভিজ্ঞতাও ছিল অল্প। তাই বুদ্ধিমতী স্ত্রীর পরামর্শ শুনলেই ভালো করতেন। ঘুমন্ত কার্পেন্টারকে ঝাঁকুনি দিয়ে কড়া গলায় শুধোলেন ক্লারেন্স-এটা কি ঘুমোবার জায়গা?