সংসারের টানাটানি আরও বৃদ্ধি পেল। শেষকালে নিরুপায় হয়ে মিল-অকির একটা অনাথ আশ্রমে রিচার্ডকে পাঠিয়ে দিতে বাধ্য হলেন ওর মা। রিচার্ড কার্পেন্টারের পরবর্তী জীবনে যে কলঙ্কময় অধ্যায়ের সৃষ্টি হয়েছিল, তার সূচনা কিন্তু এইখান থেকেই। রিচার্ডের সঙ্গে কেউই নিষ্ঠুর ব্যবহার করেনি। বরং যত্ন পরিচর্যার সীমা ছিল না সেখানে। কিন্তু বাড়ি থেকে অনেক দূরে থাকার ফলে তার মানসিক অশান্তির সীমা-পরিসীমা ছিল না। কাজেই শত চেষ্টাতেও ওর শিক্ষকেরা এদিক দিয়ে ওকে সুখী করে তুলতে পারেননি। কোনও রকম ত্রুটি ছিল না তার আচার ব্যবহারে। চোখে-মুখে এমন একটা ছেলেমানুষি মিষ্টিভাব ছিল যে ভালো না বেসে পারা যেত না। কিন্তু পড়াশুনোর দিক দিয়ে ক্রমশই পিছিয়ে পড়তে লাগল রিচার্ড। আপ্রাণ চেষ্টা করলেন শিক্ষকরা। কিন্তু কিছুতেই স্কুলের পড়াশুনোয় মন বসাতে পারল না রিচার্ড কার্পেন্টার।
ষোলো বছর বয়সে তার চাইতে অনেক কমবয়সি ছেলেদের ক্লাসে বসতে হল তাকে। সমবয়সি ছাত্ররা তাকে পেছনে ফেলে এগিয়ে গিয়েছিল। তাছাড়া, চেহারায়, পোশাকে নোংরা থাকার বদভ্যাস শুরু হয় এখান থেকেই। স্কুল ছেড়ে বেরিয়ে আসার পর ও ঘুরতে থাকে এক কাজ থেকে আর এক কাজে। কখনও হয়েছে জাহাজঘাটার কেরানী, কখনও ট্রাক-ড্রাইভার। কখনও নিয়েছে ডিশ ধোওয়ার কাজ এবং এই ধরনের আরও কত ছোটখাটো কাজ। কিন্তু কোথাও বেশিদিন টিকে থাকতে পারেনি ও। যতবার চাকরি গিয়েছে তার, ততবারই সহানুভূতির স্নিগ্ধ প্রলেপে মনের জ্বালা জুড়োনোর জন্যে ছুটে গেছে মায়ের কাছে। প্রতিবারই অভিযোগ জানিয়েছে বড়ই অসুখী আর নিঃসঙ্গ সে।
আঠারো বছর বয়েসে সৈন্যবাহিনীতে নাম লেখাল রিচার্ড কার্পেন্টার। কিন্তু মিলিটারি সম্পত্তিতে ক্ষতি করা থেকে শুরু করে এত রকম নিয়ম লঙ্ঘন আরম্ভ হল যে গার্ডহাউসেই বিস্তর সময় ব্যয় করতে হল ওকে। শেষকালে এ ধরনের অবাঞ্ছিত লোককে বরখাস্ত করা ছাড়া আর কোনও উপায় রইল না। সৈন্যবাহিনী থেকে বেরিয়ে এল রিচার্ড কার্পেন্টার শুধু একটি জিনিস ভালোভাবেই রপ্ত করে এবং তা হচ্ছে পিস্তল চালানো। কিন্তু তার চরিত্রের আশ্চর্য দিকটুকু জানলে বাস্তবিকই অবাক হতে হয়। এ হেন লোকেরও আতীব্র আসক্তি ছিল সিরিয়াস সঙ্গীত, অপেরা সিম্ফনী আর কনসার্টে। বহু রবিবাসরীয় অপরাহ্নে ক্ল্যাসিকাল রেকর্ড বাজিয়ে শুনিয়েছে ও মা-কে। ভালো ভালো রেকর্ড সংগ্রহের বাতিকেই উড়ে যেত ওর যাবতীয় উদ্বৃত্ত অর্থ।
অপরাধী জীবনের গোড়ার দিকেই দু-দুবার পুলিশ পাকড়াও করে রিচার্ড কার্পেন্টারকে। প্রথমবার সৈন্যবাহিনী থেকে বরখাস্ত হওয়ার পর বেআইনীভাবে বিস্তল বহন করার অপরাধে। সৈন্যবাহিনীতে একসময়ে যারা কাজ করেছে, হামেশাই লুকিয়ে চুরিয়ে পিস্তল সঙ্গে রাখতে দেখা যায় তাদের। কাজেই কার্পেন্টারকেও একপ্রস্থ ধমকধামক দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হল। কঠিন শাস্তি হল না। এগারো মাস পরে বাড়ির মধ্যে বসে দুটো রিভলভার পরিষ্কার করছিল রিচার্ড। হঠাৎ বন্দুক থেকে গুলি ছুটে যায়–গুলি গিয়ে লাগে ওর মায়েরই গায়ে। কপাল ভালো, খুব গুরুতর চোট লাগেনি। কিন্তু পুলিশ যখন জানতে চাইল আসল ব্যাপারটা কী, তখন চটেমটে ওর মা পুলিশমহলকেই অভিযুক্ত করে বসলেন। তারা নাকি, খামোকা তার আদুরে ছেলেকে নাজেহাল করছে।
১৯৫১ সালে রিভলভার উঁচিয়ে একজন ট্যাক্সি ড্রাইভারের কাছ থেকে আট ডলার ছিনিয়ে নেওয়ার অপরাধে গ্রেপ্তার হল রিচার্ড কার্পেন্টার। মূল সাক্ষী কিন্তু নিশ্চিতভাবে জানত না যে কার্পেন্টারই প্রকৃত অপরাধী। তা সত্ত্বেও গ্রেপ্তার করা হল ওকে। আটটা ডলার আর একটা রিভলভারও পাওয়া গেল ওর কাছ থেকেই। তাতেই আদালতের আর কোনও সন্দেহই রইল না কয়েদীর কুকীর্তি সম্বন্ধে। এক বছর কারাবাসের দণ্ড দিলেন ধর্মাবতার।
বড় কড়া দাওয়াই দেওয়া হল রিচার্ডকে। অন্তত সেইভাবেই শাস্তিটাকে নিয়েছিল ও। এক বছরের মধ্যে কোনও কয়েদীর সঙ্গেই বন্ধুত্ব করতে দেখা গেল না ওকে। মা মাঝে মাঝে আসতেন। সঙ্গে আনতেন মিঠাই আর কেক। কার্পেন্টার কাউকেই ভাগ দিত না এইসব খাবারদাবারের। খুপরির অন্যান্য কয়েদীরা আদুরে থোকা বলে খেপাত ওকে। ফলে, উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে লাগল ওর মনের জ্বালা।
শ্রীঘর থেকে বেরিয়ে এসে কার্পেন্টার প্রতিজ্ঞা করল জীবনে আর কখনও আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে খেলা করবে না। খুঁজে পেতে একটা ট্যাক্সি ড্রাইভারের কাজ জুটিয়ে ফেলল ও। প্রতি হপ্তায় আশি ডলার রোজগার করতে লাগল কার্পেন্টার। চরিত্রের মধ্যে অতিনৈষ্ঠিক বৈশিষ্ট্যের অঙ্কুরও দেখা গিয়েছিল সে সময়ে। বারবনিতা বা জুয়াড়িদের ট্যাক্সিতে তুলত না ও। নিঃসঙ্গ নেকড়ের মতোই ভয়াবহতা ওর প্রকৃতির কন্দরে সুপ্ত ছিল তখন। কিন্তু মাঝে মাঝে দুই বোন আর একজন খুড়তুতে বোনকে নিয়ে প্রায়ই সিনেমায় যেত। স্কেটিং করতেও যেত সবাইকে নিয়ে। পরে এই খুড়তুতো বোনের কাছে শুনেছিলাম–রিচার্ড নিজে কিন্তু স্কেটিং জানতো না। তবুও রাত্রে আমাদের একলা ছেড়ে দিতে চাইত না ও। অনেক সৌভাগ্য থাকলে তবে এরকম ভাই পাওয়া যায়।
তিন বোনের জন্যে সুন্দর সুন্দর পোশাক কিনে আনত রিচার্ড। নিজে কিন্তু নোংরা অগোছালো বেশবাস পরেই দিন কাটিয়ে দিত। একটি মাত্র সুট ছিল ওর। জুতোর অবস্থাও ছিল শোচনীয়–ঘন ঘন মেরামত না করলে চলত না। রীতিমতো উত্তেজনার ঝেকে যখন সন্ত্রাস সৃষ্টি করে চলছে কার্পেন্টার, তখনও কিন্তু ওর ঠাকুরদা বিশ্বাস করতে চাননি যে রিচার্ড কার্পেন্টার একজন বিপজ্জনক প্রকৃতির অপরাধী। জোর গলায় বলেছিলেন বৃদ্ধ–ভারী ভালো ছেলে ছিল ডিকি। একটু খামখেয়ালী ছিল বটে কিন্তু তাতে কি আসে যায়? ও যখন ট্যাক্সি চালাত, তখন আমার জন্যে দুটো-তিনটে সিগার আনতে কোনওদিনই ভুল হত না ওর। বাজে সিগার নয় যথেষ্ট ভালো সিগার।