দীর্ঘ শুনানির পরে ১৪ মার্চ ১৮৮৭ হাইকোর্টের বিচারপতি ম্যাকফারসনের সুচিন্তিত রায় প্রকাশিত হল। অভিযোগ প্রমাণে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছেন তারকনাথের বিধবা জ্ঞানদাসুন্দরী দাসী। প্রমাণ হল, প্রয়াত বিশ্বনাথ প্রবাস থেকে নিয়মিত তার স্ত্রীকে টাকা পাঠাতেন। বিপদ সাধল তারকনাথের এক পুরনো চিঠি, যেখানে এক আত্মীয়কে তিনি লিখছেন, সম্পত্তির প্রকৃত ক্রেতা তিনি নন, ভূবনেশ্বরী।
রায়ের বিরুদ্ধে যথাসময়ে আপিল করেছিলেন জ্ঞানদাসুন্দরী। তখনকার প্রধান বিচারপতি, বিচারপতি আর্থার উইলসন ও জাস্টিস রিচার্ড টটেনহ্যামও ভূবনেশ্বরীর পক্ষে রায় দিলেন ১৫ নভেম্বর ১৮৮৭। কিন্তু জয় অত সহজ হলো না। শাখাপ্রশাখা মিলে এই মামলার রেশ চলল স্বামীজির জীবনের শেষ শনিবার পর্যন্ত–সেই সঙ্গে অজস্র অর্থব্যয় ও সীমাহীন যন্ত্রণা।
পিতৃহীন পরিবারের জ্যেষ্ঠ সন্তান, আবার বৈরাগ্যের কঠিন সাধনা, অসহনীয় এই টানাপোড়েনে নরেন্দ্রনাথ পেয়েছিলেন তার গুরুভাইদের অবিস্মরণীয় ভালবাসা ও সমর্থন। দুই গুরুভাই নরেনের টাকার অনটন মেটাবার জন্য বরাহনগর থেকে বালির স্কুলে গিয়ে মাস্টারি করতে চাইলেন। সে বড় করুণ কাহিনি। জীবনের শেষপর্বেও স্বামীজি তাঁর প্রিয় গুরুভাইকে অনুরোধ করেছিলেন, রাখাল আমার শরীর ভাল নয়। শীগগিরই দেহত্যাগ করব। তুই আমার মার ও বাড়ির ব্যবস্থা করে দিস। তাকে তীর্থ দর্শন করাস, তোর ওপর ভারটি রইল।
হাইকোর্টের রায়ের পরেও গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটের মামলা কেমনভাবে পল্লবিত হয়ে তার তিরোধানের দিন পর্যন্ত স্বামীজিকে ক্ষতবিক্ষত করেছিল তার নানা নিদর্শন ছড়িয়ে রয়েছে বিভিন্ন চিঠিপত্রে এবং ইতিহাসের পাতায় পাতায়। হাইকোর্টে হেরে যাওয়ার পরে খুড়ি তার অংশটি ৬ হাজার টাকায় স্বামীজিকে বেঁচে দেন। মৃত্যুর কয়েক মাস আগে (মার্চ ১৯০২) সিস্টার নিবেদিতাকে স্বামীজি লিখলেন, “ইউরোপ থেকে সামান্য যে টাকা এনেছিলাম তা মায়ের দেনা শোধ এবং সংসার খরচে লেগে গেল। সামান্য যা রয়েছে তাতেও হাত দেবার উপায় নেই। ঝুলে থাকা মামলার জন্য লাগবে।”
বেলুড়ে স্বামীজির মহাসমাধি ৪ জুলাই ১৯০২। তার পাঁচ দিন আগে গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটের সমস্যা মেটাবার জন্যে স্বামীজি হঠাৎ ব্যাকুল হয়ে উঠলেন। কয়েক জন শরিকের সঙ্গে স্বেচ্ছায় দ্বন্দ্ব মিটে গেল টাকার পরিবর্তে। দুই পক্ষের অ্যাটর্নি (পিন্টু কর ও এন সি বসু) খুব দ্রুত কাজ করলেন। কারণ, অপেক্ষা করবার মতো সময় আর স্বামীজির হাতে নেই। ২ জুলাই ১৯০২ মহাসমাধির দু’দিন আগে শরিক হাবু দত্ত ও তমু দত্তর দাবি স্বেচ্ছায় মিটমাট হয়ে গেল।
স্বামীজি কিছুটা স্বস্তি নিয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে পারলেও আইনের কালো মেঘ এরপরেও মাঝে মাঝে ৩নম্বর গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটের আকাশ ঢেকে ফেলেছে।
রাজনৈতিক অপরাধে কেউ আদালতে অভিযুক্ত হলে ভূপেন্দ্রনাথ অনেক সময় বাড়ির মালিক হিসেবে জামিনদার হনে, একজন আসামি মামলা চলাকালীন উধাও হওয়ায় ভূপেন্দ্রনাথকে জামিনদার হিসেবেও জরিমানা দিতে হয়। গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটের বাড়ির অংশ বিক্রি করে সেই টাকা যে জোগাড় করতে হয়েছিল তা এই প্রজন্মে আমরা ভুলে গিয়েছি।
০২. পিতৃদেবের বেনামা উপন্যাসে পরিবারের গোপনকথা
অবশ্বাস্য বিবেকানন্দকে বুঝতে গেলে তার ভিটেবাড়ির আত্মীয়স্বজনদেরও যে বোঝা দরকার সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
স্বামীজির প্রাক্সন্ন্যাসজীবনের বিভিন্ন খুঁটিনাটি সম্পর্কে সাধারণ মানুষের আগ্রহও বেড়ে চলেছে। শৈশবে, কৈশোরে, বাল্যে ও যৌবনে কেমন দেখতে ছিলেন নরেন্দ্রনাথ দত্ত? কোথায় গেল আদিপর্বের আলোকচিত্রমালা? তার মা, বাবা, ভাইবোন সম্পর্কে আমরা কেন আরও তথ্য সংগ্রহ করতে পারছি না, ইত্যাদি নানা প্রশ্নে জর্জরিত হচ্ছেন বিশিষ্ট বিবেকানন্দ-অনুসন্ধানীরা।
কাশীপুর উদ্যানবাটীতে শ্রীরামকৃষ্ণের অন্ত্যলীলা পর্বের আগে নরেন্দ্রনাথের কোনো ফটো তোলা হয়নি তা মানতে মন চায় না। যেমন বিশ্বাস হতে চায় না যে সফল আইনজীবী ও দেশে দেশে পরিভ্রমণকারী, অভিজাতরুচি পিতৃদেব বিশ্বনাথ দত্ত মহাশয়ের কোনো ফটোগ্রাফ তোলা হয়নি। এ বিষয়ে দত্তপরিবারের ঘনিষ্ঠদের বক্তব্য : সবই ছিল, কিন্তু সবই হারিয়ে গিয়েছে পারিবারিক বিরোধে ও বারংবার পুলিসি খানাতল্লাশিতে।
পারিবারিক মামলা-মোকদ্দমা ও নরেন্দ্রনাথ দত্তের নিতান্ত আপনজনদের ভিটেবাড়ি থেকে আচমকা উৎখাতের প্রসঙ্গে যথাসময়ে আসা যাবে। বিশ্ববিজয়ী বিবেকানন্দর মহাসমাধির পরবর্তী দশকে ইংরেজ পুলিসের বিষদৃষ্টিতে গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটের দত্তভিটেতে বহুবার তল্লাশি চলে এবং শাসকরা প্রতিবারই দেওয়ালের ছবি থেকে ট্রাঙ্কের কাগজপত্র, কাপড়চোপড় সব বাজেয়াপ্ত করে সঙ্গে নিয়ে যান।
এই অত্যাচারের ফলে ঐতিহ্যমণ্ডিত দত্ত পরিবারের অনেক নিদর্শন নষ্ট হয়েছে, বিবেকানন্দ ভিটেতে কাঠের দরজা জানলা, ইটের দেওয়াল, সিমেন্টের মেঝে এবং ছাদ ছাড়া আর কিছুই অতীতের ধারাবাহিকতা বহন করছে না। এবাড়ির যা কিছু খবরাখবর তা সংগ্রহ হয়েছে মানুষের স্মৃতিকথা থেকে এবং মূল্যবান আদালতি রেকর্ড থেকে।