যথাসময়ে রামকৃষ্ণ মিশন পরামর্শ ও সাহায্য নিলেন আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে সংস্থা এবং ডি সি পি এল নামক আন্তর্জাতিক খ্যতিসম্পন্ন কোম্পানির। শেষোক্ত প্রতিষ্ঠানের প্রধান শ্ৰীমতী শান্তা ঘোষ একটি পয়সাও না নিয়ে সমস্ত কাজটি নিঃশব্দে করে দিলেন, যার আর্থিক মূল্য অন্তত এক কোটি টাকা।
স্বামী বিশোকানন্দ তার মিশন সম্পন্ন করেও সম্পূর্ণ আড়ালে থেকে যেতে চান। বহু অনুরোধের পর তিনি শুধু বললেন, “এ সবই স্বামীজির কাজ, আমাদের দিয়ে করিয়ে নিচ্ছেন। এই সুযোগ পেয়ে আমরা কৃতার্থ।”
ভিটেবাড়ির কঠিনকর্ম সম্পন্ন করে নিস্পৃহ সন্ন্যাসী বিশোকানন্দ নিঃশব্দে গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিট ত্যাগ করে ভিন্ন দায়িত্বপালনের জন্য অন্যত্র চলে গিয়েছেন।
.
স্বামী বিবেকানন্দের জন্মভিটা নিয়ে যত আইনি লড়াই হয়েছে তার পুরো ইতিহাস খাড়া করলে মস্ত একখানা বই হয়ে যায়। উকিলবাড়ির ছেলে নরেন্দ্রনাথ দত্ত কলকাতার অ্যাটর্নি পাড়ায় শিক্ষানবিশি করলেও এবং আইনপড়া সম্পূর্ণ করলেও শেষ পর্যন্ত পরীক্ষায় বসেননি এবং পরবর্তী সময়ে ভাই মহেন্দ্রনাথকে বিলেতে ব্যারিস্টারি পড়তে প্রবল বাধা দিয়েছিলেন। তবু আইন তাকে ছাড়েনি এবং সন্ন্যাসী হওয়ার পরেও পারিবারিক মামলা-মোকদ্দমার রাহু তাকে কীভাবে ঘিরে ধরেছিল তা এক নিতান্ত দুঃখজনক কাহিনি।
আপাতত আমরা শুধু তার জন্মভিটের আইনি হাঙ্গামার খোঁজখবর করব যার বিস্তৃতি অর্ধশতাব্দীর অধিক কাল ধরে। যদি জন্মভিটের পুনরুদ্ধারের জন্য রামকৃষ্ণ মিশনের দৃঢ়প্রতিজ্ঞ সন্ন্যাসীদের কথা ধরা যায় তাহলে গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটে মামলা-মোকদ্দমার অবস্থিতি উনিশ, বিশ এবং একুশ শতাব্দী জুড়ে।
দেরেটোনার দত্ত পরিবারের যে মানুষটি (রামসুন্দর) মধু রায় লেনে বসবাস করতে এসে ৩ গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটে অনেকখানি জমি-সহ বিশাল বসতবাড়ির পত্তন করলেন, তিনি প্রথমে ছিলেন সুপ্রিম কোর্টের ইংরেজ অ্যাটর্নির ম্যানেজিং ক্লার্ক এবং পরে ফার্সি আইনজীবী। আইনপাড়ায় উপার্জন করা প্রভূত অর্থ থেকেই দত্তদের এই ভিটেবাড়ির পত্তন।
রামমোহনের দুই পুত্র (দুর্গাপ্রসাদ ও কালীপ্রসাদ) ও সাত কন্যা। পঁয়ত্রিশ বছরে কালীপ্রসাদের অকালমৃত্যু কলেরায়, আর নরেন্দ্রনাথের পিতামহ দুর্গাপ্রসাদ নিতান্ত তরুণ বয়সে সন্ন্যাসী হয়ে সংসারবন্ধন ত্যাগ করে চলে গেলেও, ভিটেবাড়িতে প্রথম মামলার অনুপ্রবেশ ঘটল তারই মাধ্যমে। সেই সময়ের হিন্দু আইন অনুযায়ী কলকাতা হাইকোর্টে একটি মামলা দায়ের হয়েছিল, যার মোদ্দা কথা দুর্গাপ্রসাদ দত্ত নিরুদ্দিষ্ট, টানা বারো বছর তার কোনও সন্ধান না পাওয়ায় আদালতে তাকে মৃত ঘোষণা করা হোক।
সন্ন্যাসী হয়ে-যাওয়া দুর্গাপ্রসাদের পুত্র বিশ্বনাথ বি এ পাশ করে কিছু দিন ব্যবসা করেন, কিন্তু ব্যর্থ হয়ে ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে আইনপাড়ার অ্যাটর্নি অফিসে আর্টিকেলড ক্লার্ক হন এবং পরে হেনরি জর্জ টেম্পলের অ্যাটর্নি অফিসে যোগ দেন। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের বাবা ভুবনমোহন দাশ ওই অফিসে তার সহকর্মী ছিলেন। পরে তিনি যে অ্যাটর্নি অফিস স্থাপন করেন তার নাম ধর অ্যান্ড দত্ত।
অ্যাটর্নি হিসেবে বিশ্বনাথ প্রচুর যশ অর্জন করলেও, দত্তবাড়ির শরিকরা পরবর্তী কালের পারিবারিক মামলায় তাকে বেহিসেবি এবং আর্থিক সঙ্গতিহীন বলে অভিযোগ করেন। আমরা জানি বিবেকানন্দ-গর্ভধারিণীর দুঃখ ও নীরব বেদনা। বিশ্বনাথ একবার বলেছিলেন, “আমি এত টাকা রোজগার করি, আর আমার স্ত্রী পেট ভরে খেতে পায় না।”…বিশ্বনাথের অকালমৃত্যু ২৪ ফেব্রুয়ারি ১৮৮৪ সালে, কিন্তু তার জীবিতকালেই শরিকি লড়াইয়ের সূচনা হয়ে যায়। এর প্রথম ইন্ধন জোগানো হয় ১৮৭৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর যখন অর্থের প্রয়োজনে দত্ত পরিবারের দুই নিঃসন্তান বিধবা অবিভক্ত ভিটেতে নিজেদের অংশ নরেন্দ্ৰজননী ভূবনেশ্বরীকে বেচে দেন। ভোলানাথ দত্তর বিধবা বামাসুন্দরী ও মাধব দত্তর বিধবা বিন্দুবাসিনী এর জন্যে যে পাঁচশো টাকা করে পেয়েছিলেন তা আসলে কার উপার্জিত টাকা এই নিয়ে পরবর্তী কালে মস্ত লড়াই আদালতে। নরেন্দ্রনাথের খুড়ো হাইকোর্টের বিখ্যাত আইনজ্ঞ তারকনাথ দত্তর বিধবা জ্ঞানদাসুন্দরী বনাম বিশ্বনাথ দত্তের বিধবা ভূবনেশ্বরী দাসীর আইনি লড়াই স্বামী বিবেকানন্দর অবশিষ্ট জীবনকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল।
এই মামলার আগেও ১৮৮০ সালে অবিভক্ত বাড়ির আর এক শরিক শচীমণি দাসী (গৌরমোহন দত্তের দৌহিত্রী) ভিটেবাড়ি বিভাজন মামলা এনেছিলেন কলকাতা হাইকোর্টে যাতে অন্য সকলের সঙ্গে বিবেকানন্দ জননী ভূবনেশ্বরীও ছিলেন প্রতিপক্ষ। পরের বছরে আদালতের নির্দেশে কলকাতার বিখ্যাত অ্যাটর্নি রবার্ট বেলচেম্বার্স সম্পত্তি বিভাজনের কমিশনার নিযুক্ত হন এবং চার বছর ধরে সব কিছু খুঁটিয়ে দেখে তিনি দত্তবাড়ির শরিকদের ভাগ ঠিক করে দেন। বেলচেম্বার্সের স্বাক্ষরিত ৩ নম্বর গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটের নকশাই পরবর্তী সময়ে বিবেকানন্দ ভিটের পুনরুদ্ধার ও সংস্কারে মঠ ও মিশনের খুব কাজে লেগে যায়।
নরেন্দ্রনাথের বাবা বিশ্বনাথ দত্তের অকালমৃত্যুর পরেই উকিল তারকনাথ ভূবনেশ্বরীর নামে কেনা সম্পত্তি তার বেনামি সম্পত্তি বলে দাবি করতে থাকেন। ১৮৮৫ বড়দিনের সময় এই বাড়ির একটা অংশে বাথরুম মেরামতির জন্য পুরনো দেয়াল ভাঙা নিয়ে ভূবনেশ্বরীর পরিবারের সঙ্গে তারকনাথ উত্তপ্ত কথা কাটাকাটিতে জড়িয়ে পড়লেন। এই মামলায় যথাসময়ে সাক্ষীর কাঠগড়ায় উঠেছিলেন স্বয়ং নরেন্দ্রনাথ। হাইকোর্টে বিচারপতির নাম উইলিয়াম ম্যাকফারসন। নরেন্দ্রনাথ যখন সাক্ষ্য দেন (৮ মার্চ, ১৮৮৭) তখন শ্রীরামকৃষ্ণ মহাসমাধি লাভ করেছেন, তাঁর ত্যাগী সন্তানরা তখন তপস্যাদীপ্ত বরাহনগরের মঠবাসী। নিরুপায় নরেন্দ্রনাথ হাইকোর্টে যেতেন পায়ে হেঁটে, আর ভূবনেশ্বরী যেতেন পাল্কিতে। নরেন্দ্রনাথের সাক্ষ্যের কিছু অংশ: “..কয়েক মাস পিত্রালয়ে থেকে আমার মা ৩ নম্বর গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটে ফিরে এসে দেখেন তাঁরই জমির একটা অংশে তারকনাথ দত্ত একটি পাকা ঘর তৈরি শুরু করেছেন।..ঘটনাস্থলে মায়ের পক্ষ নিয়ে আমি আপত্তি তুলেছিলাম।”