সব হিন্দু বাড়িতেই তুলসী গাছ রাখতে হত।
চাকররা গোঁফ রাখতে পারত না। পাইকরা কিন্তু সেই সুবিধা পেত।
*
৩ গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটের বাড়িতে নরেন্দ্রনাথ দত্তর জন্ম ১২ জানুয়ারি ১৮৬৩ সোমবার সকাল ৬টা ৪৯ মিনিটে। শৈশব, বাল্য ও যৌবনলীলা এখানেই সাঙ্গ করে তেইশ বছর বয়সে সন্ন্যাসগ্রহণ করেন নরেন্দ্রনাথ দত্ত, যিনি প্রথমে বিবিদিষানন্দ, পরে কিছু সময় সচ্চিদানন্দ এবং অবশেষে স্বামী বিবেকানন্দ।
নামকরা উকিলবাড়ির আদরের সন্তান, কিন্তু ৩ গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটের বাসিন্দা নরেন্দ্রনাথের কৈশোর, বাল্য, যৌবনের কোনও ফটো কারও সংগ্রহে নেই। বিদেশিনী অনুরাগিণী মিস জোসেফিন ম্যাকলাউড ভারতভ্রমণে এসে কোথাও নাকি কলেজের ছাত্র, তারুণ্যেভরা নরেন্দ্রনাথের একখানা ছবি দেখেছিলেন। কিন্তু বিশ শতকের গোড়ায় দত্তবাড়িতে হৃদয়হীন ইংরেজ পুলিশের এমন কৃপাদৃষ্টি পড়েছিল যে সব ইতিহাস তছনছ হয়ে গিয়েছে। ফলে এখনকার চিত্রসংগ্রহে তার প্রথম ছবিটি ২৩ বছর বয়সের সাধক নরেন্দ্রনাথের, কলকাতায় কাশীপুর উদ্যানবাটিতে তোলা ১৮৮৬ সালে। এই ছবিটি কেমনভাবে তোলা হল তার কোনও বিস্তৃত বিবরণ নেই।
পিতৃদেব বিশ্বনাথ ও মাতা ভূবনেশ্বরীর সংসার ছোট ছিল না। ভাই মহেন্দ্রনাথ ছিলেন নরেন্দ্রনাথের ছ’বছরের ছোট। তার কাছে দত্তবাড়ির নানা নির্ভরযোগ্য তথ্যের জন্য আমরা কৃতজ্ঞ। তার তুলনাহীন বর্ণনা : “গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটের বাড়ি খুব প্রশস্ত ছিল। বাড়ির অভ্যন্তর দেড় বিঘা ছিল এবং আশেপাশে অনেক জমিতে রেওয়ত ছিল। বাড়ির বর্ণনা বলিতে হইলে প্রথম ঠাকুরদালান হইতে আরম্ভ করিতে হয়। পাঁচফুকুরী ঠাকুরদালান পশ্চিমমুখী, অর্থাৎ ইহার পাঁচটি খিলান ও গোল ইটের থাম। ঠাকুরদালানের সম্মুখে বড় প্রাঙ্গণ। ঠাকুরদালানের উপরের দক্ষিণ দিকে দুইতলা বড় হলঘর। উত্তরদিকের ঘরটিকে ‘বড় বৈঠকখানা ঘর’ বলা হইত। দক্ষিণ দিকে নীচের ঘরটিকে বোধন ঘর’বলা হইত এবং উপরকার ঘরটিকে ‘ঠাকুরঘর’ বলা হইত। তাহার পর বাহিরের উঠানে চকমিলান দালান ও ঘর। অন্দরমহলে দুইদিকে দুটি উঠান ছিল এবং পিছন দিকে কানাচ বা পুকুর ছিল।”
কেমন ছিল সেকালের দত্তবাড়ির খাওয়াদাওয়া? শুনুন ভ্রাতা মহেন্দ্রনাথের নিজের মুখে : “তখন কলকাতায় পাঁঠার মুড়ি বিক্রি হত না, আমরা পাঁঠাওয়ালাদের সঙ্গে বন্দোবস্ত করেছিলাম যে, তার দোকানে যে কটা মুড়ি থাকবে, আমাদের জন্যে রেখে দেবে। …দশ বারোটা পাঁঠার মুড়ি, সের দুই আড়াই ওলন্দ কড়াইশুটি, এক সঙ্গে ফুটিয়ে একটা তরকারি হত। বিকেলবেলা স্বামীজি আর আমি স্কুল থেকে এসে, আমরা দু’জন ওই কড়াইশুটি দেওয়া ব্রেনের তরকারি দিয়ে, খান-যোলো করে রুটি খেতুম।”
অনেক দিন পরে দক্ষিণেশ্বরের শরৎকে (স্বামী সারদানন্দ) শ্রীরামকৃষ্ণ নির্দেশ দিলেন, নরেনকে দেখে আয়, “নরেন্দ্রনাথ কায়েতের ছেলে, বাপ উকিল, বাড়ি সিমলে”। ১৮৮৫ সালের জ্যৈষ্ঠমাসে শরৎ ও ভ্রাতা শশী (পরে স্বামী রামকৃষ্ণানন্দ) বেলা আড়াইটার সময় ৩ নম্বর গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটে এলেন। পিতার মৃত্যুর পর ভূবনেশ্বরী পরিবারের শোচনীয় অবস্থা।”কেবল একখানি ভাঙা তক্তপোষ, একটা মাদুর ভাজকরা, ঘরের পশ্চিমদিকের তক্তপোষের উপর তুলা বের করা একটা গদি, দু’একটা ছেঁড়া বালিশ আর পশ্চিমদিকে একটা কালো মশারি পেরেকের উপর গুটান, কড়িকাঠ হইতে একটা টানা-পাখার ঘেঁড়া ঝালর ঝুলিতেছে।”
এ বাড়ির ওপর দিয়ে তার পরে নানা সময়ে নানা রকম ঝড় বয়ে গিয়েছে। নরেন্দ্রনাথ সন্ন্যাসী হলেন ১৮৮৬ সালে, বাড়ির শরিকি মামলা একটু আয়ত্তে আসবার পরেই তিনি পরিব্রাজক হলেন এবং ১৮৯৩-তে মুম্বই থেকে জাহাজে চড়লেন আমেরিকার উদ্দেশে। বিশ্বজয়ী হয়ে প্রথম দেশে ফিরলেন ১৮৯৭ সালে। আবার বিদেশ যাত্রা ১৮৯৯ সালে, শেষবারের মতো ফিরে এলেন ১৯০০ সালের ৯ ডিসেম্বর।
ইতিমধ্যে গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটে নানা বিপর্যয় ঘটে গিয়েছে। মেজ ভাই মহেন্দ্রনাথ দত্ত খেতড়ির মহারাজের আর্থিক সাহায্য নিয়ে দাদাকে অগ্রিম না জানিয়েই আচমকা হাজির হলেন লন্ডনে, উদ্দেশ্য ব্যারিস্টারি পড়বেন। নিজে কোথায় থাকবেন ঠিক নেই, এই অবস্থায় সহায় সম্বলহীন ভাইকে দেখে বিবেকানন্দ মোটেই সন্তুষ্ট হলেন না। তার ইচ্ছে ভাই ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে আমেরিকায় যান। অভিমানী মহেন্দ্রনাথ স্থির করলেন দাদার কাছে জাহাজ ভাড়া না নিয়ে পায়ে হেঁটেই ভারতে ফিরবেন। পদযাত্রায় বেশ কয়েক বছর লাগল। এই পর্যায়ে বাড়িতে তিনি কোনও চিঠি লেখেননি। ৪ জুলাই ১৯০২ সালে মহেন্দ্রনাথ বহু দেশ পেরিয়ে কাশ্মীরে, স্বামী সারদানন্দের কাছে দাদার মৃত্যু সংবাদ পেয়ে দ্রুত ৩ গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটে ফিরে এলেন।
জননী ভূবনেশ্বরীর কিন্তু জীবনে একবিন্দু শান্তি নেই। দারিদ্র ও শোকের সঙ্গে লড়াই করতে করতে কিছুদিন পরেই শুনলেন ছোট ছেলে ভূপেন্দ্রনাথ গোপনে দেশের বিপ্লব আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েছে। ১৯০৭ সালে রাজদ্রোহের অভিযোগে কলকাতার আদালতে ভূপেন্দ্রনাথের এক বছর জেল হল। সেখানে ঘানি টানতে হত, জেল খাটার পরে আবার আটক হবার আশঙ্কায় মায়ের অর্থানুকূল্যে এবং সিস্টার নিবেদিতার পরামর্শে আত্মপরিচয় গোপন করে দেশ ছেড়ে প্রথমে আমেরিকায় চলে গেলেন ভূপেন্দ্রনাথ, মায়ের সঙ্গে তাঁর আর দেখা হয়নি। আমেরিকা থেকে ইউরোপে গিয়ে কমিউনিস্ট আন্দোলনে রোমাঞ্চকর অংশ নিয়ে ডক্টর ভূপেন্দ্রনাথ দেশে ফেরেন ১৯২৫ সালে।