বিবেকানন্দ ভ্রাতা মহেন্দ্রনাথ প্রথম শ্রীরামকৃষ্ণকে দেখেন উত্তর কলকাতায় মধু রায় লেনে রামদাদার বাড়িতে। স্মরণীয় সেই দর্শনের মনোগ্রাহী বিবরণ তিনি রেখে গিয়েছেন। “বিকালে পরমহংস মশাই রামদাদার বাড়িতে এলেন। দিনটি শনিবার কি রবিবার হবে। ঘরে ও বাইরে মোট চল্লিশ জনের মতন লোক। পরমহংস মশাই পশ্চিমদিকের আলমারির বা সার্শি দেওয়া তাকের কাছে বসে আছেন, পিছনে তাকিয়া। দুটি গ্যাসের বাতি জ্বলছে।
“আমার প্রথম এইরূপ মনে হইল–দক্ষিণেশ্বর থেকে এই যে লোকটি এসেছে, একেই কি বলে ‘পরমহংস’? দেখিলাম লোকটির চেহারাতে কোন বৈশিষ্ট্য নাই, চেহারা সাধারণ পাড়াগেঁয়ে লোকের মত, বর্ণ খুব কালো নয়, তবে কলিকাতার সাধারণ লোকের বর্ণ হইতে কিছু মলিন। গালে একটু একটু দাড়ি আছে, কপচানো দাড়ি। চোখ দুটি ছোট–যাহাকে বলে হাতি চোখ। চোখের পাতা অনবরত মিট মিট করিতেছে, যেন অধিক পরিমাণে চোখ নড়িতেছে। ঠোঁট দুটি পাতলা নয়। নিচুকার ঠোঁট একটু পুরু। ঠোঁট দুটির মধ্য হইতে উপরের দাঁতের সারির মাঝের কয়েকটি দাঁত একটু বাহির হইয়া রহিয়াছে। গায়ে জামা ছিল; তাহার আস্তিনটা কনুই ও কবজির মাঝবরাবর আসিয়াছে। খানিকক্ষণ পরে, জামা খুলিয়া পাশে রাখিয়া দিল এবং কোঁচার কাপড়টি লম্বা করিয়া বাঁ কাঁধে দিল। ঘরটি বেশ গরম হইয়াছিল। একজন লোক বড় এড়ানী পাখ অর্থাৎ বড় পাখা লইয়া পিছন দিক হইতে বাতাস করিতে লাগিল। কথাবার্তার ভাষা কলিকাতার শিক্ষিত সমাজের ভাষার মতো নয়, অতি গ্রাম্য ভাষা, এমনকি, কলিকাতার শহরের রুচি বিগর্হিত। কথাগুলি একটু তোতলার মতো। রাঢ়দেশীয় লোকের মতো উচ্চারণ। ন এর জায়গায় ল উচ্চারণ করিতেছে, যেমন লরেনকে বললুম’ ইত্যাদি। সম্মুখে একটি রঙিন বটুয়া রহিয়াছে, তাহার মধ্যে কি মসলা আছে; মাঝে মাঝে একটু মসলা লইয়া মুখে দিতেছে।
আমাদের বয়স তখন অল্প এবং আমরা শিক্ষিত সমাজে পরিবর্ধিত, এইজন্য, ভাষা ও উচ্চারণ শুনিয়া পরমহংস মশাই-এর প্রতি মনে একটি অবজ্ঞার ভাব আসিল–এই লোকটাকে রামদাদা কেন এত সম্মান ও শ্রদ্ধা ভক্তি করেন? চুপ করিয়া বসিয়া সব দেখিতে লাগিলাম। মনে মনে আবার ভাবিতে লাগিলাম–কেন রামদাদা এই লোকটাকে এত সম্মান করেন; দুর্ধর্ষ সুরেশ মিত্তির এবং বুদ্ধিমান নরেন্দ্রনাথই বা কেন কয়েকবার এর কাছে গেছেন? লোকটার কি ব্যাপার?”
মহেন্দ্রনাথ রামকৃষ্ণর প্রথম দর্শনের যে বিবরণ রেখে গিয়েছেন তার মধ্যে আকস্মিক ভাবসমাধিরও বর্ণনা আছে।
আরও মনোগ্রাহী বর্ণনা মহেন্দ্রনাথ শুনেছিলেন লীলাপ্রসঙ্গর রচয়িতা স্বামী সারদানন্দের কাছে। স্বামী সারদানন্দ ও মহেন্দ্রনাথ পরবর্তী সময়ে কিছুদিন একত্রে লন্ডনে সময় কাটিয়েছিলেন।
একবার পুজোর সময় পরমহংসদেব ডস্ট কোম্পানির মুছুদী গৃহীভক্ত সুরেশ মিত্তিরের (১৮৫০-৯০) বাড়িতে গিয়েছিলেন। ঠাকুরদালানে মারবেল পাথরের মেঝের উপর তাকে খেতে দেওয়া হয়েছিল।
“মেয়েরা ঘরে জানালা হইতে পরমহংস মশাইকে দেখিতেছিলেন। পরমহংস মশাই-এর সম্মুখে অনেক লোক দাঁড়াইয়া তাহাকে আহার করাইতেছিলেন। পরমহংস মশাই উপু হইয়া বসিয়া আহার করিতেছিলেন। এইরূপ বসিয়া আহার করাই তাঁহার দেশের প্রথা। আমরাও দেখিয়াছি যে, পরমহংস মশাই আসনপিড়ি হইয়া বসিয়া আহার করিতেন না, হাঁটু দুইটি উঁচু করিয়া উপু হইয়া বসিয়া আহার করিতেন।
“তিনি আহার করিতেছেন ও বলিতেছেন যে, পূর্বে তিনি বড় বিভোর থাকিতেন, বাহ্যজ্ঞান কিছুই থাকিত না, কাপড় পরার কথা মনে থাকিত না, একেবারেই বে-ভুল, বে-এক্তিয়ার হইয়া থাকিতেন, কিন্তু এখন তাহার সে ভাবটি কাটিয়া গিয়াছে, এখন তিনি কাপড় পরিয়া থাকেন এবং লোকজনের সম্মুখে বেশ সভ্যভব্য হইয়া বসিয়া থাকেন। এই কথা শুনিয়া উপস্থিত লোকসকল ও যে সকল মেয়েরা জানালা হইতে দেখিতেছিলেন, একটু হাসিয়া উঠিলেন। কেহ কেহ হাসিয়া বলিলেন, “আজ্ঞে ও-কথা ঠিক তো বটেই। সকলে এই বলিয়া আমোদ করিয়া তাহাকে একটু উপহাস করিতে লাগিলেন।
পরমহংস মশাই উপু হইয়া বসিয়া একটু একটু খাইতেছেন ও এইরূপ কথা চলিতেছে। সকলেই মৃদু মৃদু হাসিতেছেন। বাঁদিকের বগলের প্রতি হঠাৎ পরমহংস মশাই-এর দৃষ্টি পড়িল। তিনি দেখেন যে, কাপড়খানি বাঁ-বগলের ভেতর জড়ানো রহিয়াছে আর তিনি দিগবসন হইয়া বসিয়া আছেন।
“এইরূপ দেখিয়া তিনি অপ্রতিভ হইয়া বলিলেন, “আরে ছ্যা! আমার ওটা গেল না; কাপড় পরাটা আর মনে থাকে না! এই বলিয়া তিনি তাড়াতাড়ি কাপড়খানি লইয়া কোমরে জড়াইতে লাগিলেন। যে সকল পুরুষ দাঁড়াইয়াছিলেন, তাঁহার সকলে উচ্চতরালে হাসিয়া উঠিলেন, মেয়েরাও জানালা হইতে হাসিয়া উঠিলেন।
“কিন্তু পরমহংস মশাই-এর ভাব এত সরল, স্নিগ্ধ ও উচ্চ ছিল যে, কাহারো মনে দ্বিধা বা সংকোচ না আসিয়া এক অতীন্দ্রিয় ভাব আসিল। কেহ কেহ বলিলেন মশাই, আপনার কাপড় পরবার দরকার নেই। আপনি যেমন আছেন, তেমনি থাকুন। আপনার কোন দোষ হয় না।”
এদেশে প্রত্যক্ষদর্শীদের স্মৃতিকথায় স্মরণীয় মানুষদের দেহবর্ণনা খুবই কম থাকে। ফলে, রামকৃষ্ণ, রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ, শ্রীঅরবিন্দর দৈহিক উচ্চতা কত ছিল, গায়ের রং কীরকম, মুখের ভাস্কর্য কীরকম এসব জানতেও হিমশিম খেতে হয়। পশ্চিমের লেখকরা তাদের স্বাভাবিক বিচক্ষণতায় নিতান্ত প্রয়োজনীয় এই কাজগুলি প্রথমেই সেরে নেন। এই সমস্যা পরমহংসদেবের ক্ষেত্রেও যথেষ্ট। সাবধানী মহেন্দ্রনাথ দত্ত তার শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণের অনুধ্যান নামক ছোট্ট বইতে দাদা নরেন্দ্রনাথ ও গুরু রামকৃষ্ণের সম্বন্ধে কিছু দৈহিক বিবরণ রেখে দিয়েছেন।