সময়াভাব ছিল। নির্বাচিত শিষ্যটি পঞ্চাশ বছরও বাঁচলেন না, হিসেব অনুযায়ী আচার্যের দেহাবসানের পরে মাত্র পনেরোটি বছর এবং কয়েকটি মাস। ম্যানেজমেন্ট শাস্ত্রের বিশেষজ্ঞদের মতে অকালমৃত্যু আদর্শ সাকসেশন প্ল্যানের পরিপন্থী। অর্থাৎ নিজে পঞ্চাশ বছরে বিদায় নিয়ে, পরবর্তী দায়িত্ববানের চল্লিশ বছরের আগেই চলে যাওয়াটা ভালো কথা নয়। সত্যি কথাটা হল, রামকৃষ্ণসঙ্রে অন্তর্নিহিত প্রাণশক্তি যে কোনো ব্যক্তিবিশেষের ওপর নির্ভরশীল নয় তার প্রমাণ রামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দের স্বল্পপরিসর জীবন।
রামকৃষ্ণ আন্দোলনের আর একটি বৈশিষ্ট্য সন্ন্যাসী ও গৃহী উভয়েরই সগৌরব উপস্থিতি। মূল মঠ ও মিশনে ত্যাগী সন্ন্যাসীদের ওপর নির্ভরতা, কিন্তু গৃহীদের সমর্থন ছাড়া যে, এই ধরনের প্রতিষ্ঠান নিঃসঙ্গ হয়ে উঠতে পারে তাও পুরোপুরি উপস্থিত।
১৭৫ বছরের পরও কেমন করে নট আউট? এই বিপুল প্রাণশক্তির গোপন উৎস কোথায়? তা খোঁজ করলে সংসারত্যাগী সন্ন্যাসীদের ভূমিকা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
সন্ন্যাসী হওয়া সহজ নয়, সে এক দুর্গম জীবনযাত্রা। তবু এক শতাব্দীর বেশি সময় ধরে দেশজননী নিয়মিতভাবে সন্তান দান করে চলেছেন সন্ন্যাসী সঙ্ঘকে এবং তাদের বিপুল নিষ্ঠায় এবং দিবারাত্রের সাধনায় সন্ন্যাসজীবন সকলের শ্রদ্ধা ও বিস্ময়ের বিষয় হয়ে উঠেছে। নবীন এই সন্ন্যাসীসঙ্রে কাছে বিপুল প্রত্যাশা ছিল প্রতিষ্ঠাতা স্বামী বিবেকানন্দের। “শ্রীরামকৃষ্ণের দিব্যচরণ স্পর্শে যে মুষ্টিমেয় যুবকদলের অভ্যুদয় হয়েছে, তাদের প্রতি দৃষ্টিপাত কর। তারা আসাম থেকে সিন্ধু, হিমালয় থেকে কুমারিকা পর্যন্ত তাঁর উপদেশামৃত প্রচার করছে। তারা পদব্রজে ২৩,০০০ ফুট উধ্বে হিমালয়ের তুষাররাশি অতিক্রম করে তিব্বতের রহস্য ভেদ করেছে। তারা চীরধারী হয়ে দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করেছে।”
সন্ন্যাসী ব্যাপারটা কী তা বিবেকানন্দ একবার বিদেশিদের কাছে ব্যাখ্যার চেষ্টা করেছিলেন। “আমি যে-সম্প্রদায়ভুক্ত তাকে বলা হয় সন্ন্যাসি-সম্প্রদায়। সন্ন্যাসী’ শব্দের অর্থ “যে ব্যক্তি সম্যকভাবে ত্যাগ করেছে। এটি অতি প্রাচীন সম্প্রদায়। যীশুর জন্মের ৫৬০ বছর আগে বুদ্ধও এই সম্প্রদায়ভুক্ত ছিলেন। তিনি তার সম্প্রদায়ের অন্যতম সংস্কারক মাত্র। পৃথিবীর প্রাচীনতম গ্রন্থ বেদেও আপনারা সন্ন্যাসীর উল্লেখ পাবেন। সন্ন্যাসী-সম্প্রদায় বলতে চার্চ বোঝায় না এবং এই সম্প্রদায়ভুক্ত ব্যক্তিরা পুরোহিত নন। পুরোহিত এবং সন্ন্যাসীর মধ্যে আকাশ পাতাল প্রভেদ। সন্ন্যাসীদের সম্পত্তি থাকে না, তারা বিয়ে করেন না, তাদের কোনো সংস্থা নেই। তাদের একমাত্র বন্ধন গুরুশিষ্যের বন্ধন। এই বন্ধনটি ভারতবর্ষের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। শুধু শিক্ষাদানের জন্য যিনি আসেন এবং সেই শিক্ষার জন্য কিছু মূল্য বিনিময় করেই যাঁর সঙ্গে সম্বন্ধ চুকে যায়, তিনি প্রকৃত শিক্ষক নন। ভারতবর্ষে এটি প্রকৃত অর্থে দত্তক গ্রহণের মতো। শিক্ষাদাতা গুরু আমার পিতার অধিক, আমি তার সন্তান। সর্বাগ্রে পিতারও আগে, তাকে শ্রদ্ধা করব এবং তার বশ্যতা স্বীকার করব, কারণ ভারতবাসীরা বলেন, পিতা আমার জন্মদান করেছেন কিন্তু গুরু আমাকে মুক্তির পথ দেখিয়েছেন, সুতরাং পিতা অপেক্ষা গুরু মহত্তর। আজীবন আমরা গুরুর প্রতি এই শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা পোষণ করি।”
গুরু সম্বন্ধে স্বামীজির মন্তব্য আজও পাঠযোগ্য। “এক বৃদ্ধকে আমি গুরুরূপে পেয়েছিলাম, তিনি অদ্ভুত লোক।” ‘বৃদ্ধ’ শব্দটি হিসেবিদের কানে একটু ধাক্কা দেয়, কারণ রামকৃষ্ণ-নরেন্দ্রর সাক্ষাৎকার ১৮৮১ সালে, গুরুর বয়স তখন পঁয়তাল্লিশ এবং তৎকালীন ফটোগ্রাফে তাঁকে বার্ধক্যতাড়িত মনে হয় না। শারীরিক বিপর্যটা ঘটেছিল তিরোধানের কয়েক মাস আগে কাশীপুর উদ্যানবাটিতে ১৮৮৬ সালে। সদাশয় ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকার মহানিদ্রায় শায়িত শ্রীরামকৃষ্ণের শেষ যে ছবিটি তোলবার জন্য দশ টাকা অর্থসাহায্য করেছিলেন সেটি দেখলে মন দুঃখে ভরে ওঠে।
এবার গুরু-শিষ্যের প্রথম পরিচয় নিয়ে সামান্য কিছু আলোচনা। নরেন্দ্রনাথের মেজ ভাই এ-বিষয়ে রসগোল্লার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা সম্বন্ধে যা লিখেছেন তা কমবয়সিদের বেশ ভালো লাগে। ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দে নরেন্দ্রনাথের আত্মীয় ডাক্তার রামচন্দ্র দত্তের বাড়িতে বিসূচিকা রোগে তিনটি ছোট মেয়ে (মেয়ে ও ভাগ্নি) সাতদিনের মধ্যে মারা যায়। শোকার্ত রাম দত্ত এই সময় শান্তি সন্ধানে দক্ষিণেশ্বরে পরমহংসদেবের কাছে যাতায়াত শুরু করেন। লোকেরা তখন হাসি ও ব্যঙ্গচ্ছলে পরমহংসদেবকে great goose বলত। রামদাদার মাধ্যমেই সিমলের সঙ্গে দক্ষিণেশ্বরের যোগাযোগের সূত্রপাত।
রামদাদা এঁর কাছে দীক্ষা নেওয়ায় নানা নিন্দার সম্মুখীন হতেন, কিন্তু তাঁর গুরুপ্রশস্তিতে ভাটা পড়েনি। তিনি নরেন্দ্রর পড়শি সুরেন্দ্রনাথ মিত্রকে (পরবর্তীকালে ঠাকুর যাকে আদর করে সুরেশ’ বলে ডাকতেন) ঠাকুরের কথা বলেন। সুরেশ নরম না হয়ে পরিহাস করেছিলেন, “ওহে রাম, তোমার গুরু পরমহংস যদি আমার কথার উত্তর দিতে পারে, তবে ভালো, নইলে তার কান মলে দিয়ে আসব।”
সেকালের কলকাতার কথার স্টাইল অনুযায়ী আর একজন ডাক্তার (স্যর কৈলাসচন্দ্র বসু) একই ভাষায় বলেছিলেন, “রাম, তোমার পরমহংস যদি ভালো লোক হয় ভালো, নইলে তার কান মলে দেব।” বোঝা যাচ্ছে, কান মলে দেবার ইচ্ছা প্রকাশই অবজ্ঞা প্রকাশ করবার রীতি ছিল!