১১ আগস্ট হাইকোর্টে ভূবনেশ্বরীর আবেদন : প্রয়াত স্বামীর মক্কেলদের কাছ থেকে অনাদায়ী টাকা আদায়ের ছাড়পত্রের জন্য। মায়ের বাংলা সই সনাক্ত করলেন নরেন্দ্রনাথ দত্ত।
১২ আগস্ট হাইকোর্টে ভূবনেশ্বরীর আবেদন মঞ্জুর–আদালত থেকে বেরিয়েই নরেন্দ্রনাথ ছুটলেন কাশীপুর উদ্যানবাটীতে–গলায় ক্যানসার রোগে ঠাকুর সেখানে মৃত্যুশয্যায়।
১৬ আগস্ট কাশীপুর উদ্যানবাটীতে রাত্রি ১টা ২ মিনিটে ঠাকুর শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণের মর্তলীলার অবসান।
২৮ নভেম্বর জ্ঞানদাসুন্দরী ভিটেবাড়ির মালিকানা নিয়ে যে মামলা দায়ের করেছেন অ্যাটর্নি নিমাই বসুর মাধ্যমে ভূবনেশ্বরী ও নরেন্দ্রনাথ তার বিস্তারিত জবাব দিলেন।
১৮৮৭ কলকাতা হাইকোর্টে বিচারপতি উইলিয়ম ম্যাকফারলেনের কক্ষে বিচার শুরু। দু’পক্ষের সাক্ষীসাবুদ অনেক। এঁদের মধ্যে আছেন প্রতিবেশী ডাক্তার চন্দ্রনাথ ঘোষ ও দত্ত বাড়ির পুরোহিত সারদাপ্রসাদ মজুমদার।
৮মার্চ স্বয়ং নরেন্দ্রনাথ হাইকোর্টে সাক্ষীর কাঠগড়ায় দাঁড়ালেন। তাকে জেরা করলেন বিখ্যাত ইংরেজ ব্যারিস্টার পিউ সায়েব। পেশা কি এই প্রশ্নের উত্তরে নরেন্দ্রনাথ বললেন, আমি বেকার।
১৪ মার্চ হাইকোর্টের রায়–জ্ঞানদাসুন্দরী অভিযোগ প্রমাণে ব্যর্থ হয়েছেন, মামলার সব ব্যয়ভার তাকেই বহন করতে হবে। জ্ঞানদাসুন্দরী হাইকোর্টে আপীল ফাঁইল করলেন।
১৫ নভেম্বর প্রধান বিচারপতি, বিচারপতি আর্থার উইলসন ও বিচারপতি রিচার্ড টটেনহ্যাম পূর্বতন রায় বহাল রাখলেন, জয় বিশ্বনাথ পত্নী নরেন্দ্ৰজননী ভূবনেশ্বরীর।
১৮৮৮ ২০ জানুয়ারি সম্পত্তি বিভাজনের জন্য শচীমণির মামলা আদালতের এক স্থগিতাদেশে এতোদিন ঝুলে ছিল। পূর্বতন বাঁটোয়ারা রায় কার্যকরী করার জন্যে ভুবনেশ্বরীর পক্ষে আদালতে আবেদন। আদালতের হস্তক্ষেপে ভূবনেশ্বরী তার অংশ বুঝে পেলেন।
০৪. নট আউট শুরুর নট আউট শিষ্য
স্বামী বিবেকানন্দ এবং তার আচার্য শ্রীরামকৃষ্ণ অনেক ব্যাপারেই আলাদা, তাদের আচার ও আচরণও অবিশ্বাস্য। এঁদের প্রথম মিলনে বাংলার রসগোল্লার মস্ত ভূমিকা রয়েছে। ঠাকুরের ভক্ত এবং নরেন্দ্রনাথের আত্মীয় ডাক্তার রামচন্দ্র দত্ত তার নরেনকে আধ্যাত্মিক কথা বলেননি, বলেছিলেন দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে গেলে ভটচায্যিমশাই খুব ভাল রসগোল্লা খাওয়ান।
দু’জনের দেখা-সাক্ষাৎ থেকেই অবিশ্বাস্য এক আন্দোলন গড়ে উঠল। বিবেকানন্দজীবনে বিস্তারিতভাবে প্রবেশের আগে গুরুটিকে একটু ভালভাবে জেনে রাখা দরকার এবং সেই সঙ্গে শিষ্যটির কী সম্পর্ক দাঁড়াল।
হিসেব মতে, ২০১০ সালে আমাদের পরমপুরুষ ১৭৫ নট আউট, যদিও তাঁর নশ্বর দেহত্যাগ এই কলকাতা শহরে মাত্র ৫০ বছর বয়সে। তারপরেও হেসে খেলে ১২৫ বছর কেমন করে দক্ষিণেশ্বর কালীমন্দিরের মাসিক পাঁচ টাকা মাইনের ছোটভচায্যি বেঁচে রইলেন তা ঐতিহাসিকদের এবং সমাজতত্ত্ববিদদের কাছে এক পরমবিস্ময়। ইতিহাসের ফর্মুলা অনুযায়ী ব্যাপারটা ভীষণই কঠিন, কিন্তু খেয়ালি মহাকাল সিদ্ধান্ত নিয়ে বসে আছেন, রানি রাসমণির ভবতারিণী মন্দিরের প্রায়-নিরক্ষর, জুনিয়র পুরোহিত একদিন এদেশের হৃদয়েশ্বর হয়ে উঠবেন এবং তাঁর জীবন ও বাণী সাগরপারের অনুসন্ধিৎসুদেরও আলোচ্য বিষয় হয়ে উঠবে।
তাকে যুগাবতারও বলা হয়েছে, ঘরে ঘরে তার জন্য মঙ্গলশঙ্খ বাজে। তাকে যাঁরা ঠিকমতন বুঝতে পেরেছেন তারা নিশ্চিত ১৭৫ নট আউটটা ঠাকুর রামকৃষ্ণের পক্ষে কিছুই নয়, তার প্রধান চেলার অতিশয়োক্তি দোষ ছিল না। সেই উনিশ শতকের শেষপ্রান্তের বেলুড় মঠের পুণ্যভূমিতে দাঁড়িয়ে সন্ন্যাসী বিবেকানন্দ ঘোষণা করেছিলেন, দেড় হাজার বছরের মধ্যে তার পুনরাবির্ভাব হবে এবং তার আগের দেড় হাজার বছর তিনি রামকৃষ্ণসঘের মধ্যেই বেঁচে থাকবেন, আরও স্পষ্টভাবে বলতে গেলে সার্ধশতবর্ষ নয়, সাধসহস্রবছর ধরে শ্রীরামকৃষ্ণের অপ্রতিহত ঠিকানা এই রামৃষ্ণ মঠ ও মিশন।
গুরু তাঁর দিব্যচক্ষু দিয়ে প্রধান চেলাটিকে সযত্নে নির্বাচন করে সস্নেহে লালন করেছিলেন। হাতে তেমন সময় ছিল না, যন্ত্রণাময় ক্যানসার-কণ্টকিত রোগভোগের মধ্যেই দূরদর্শী ম্যানেজমেন্ট বিশেষজ্ঞর মতো তিনি সকল ভক্তের নৈতিক সমর্থন ও উৎসাহ নিয়ে নরেন্দ্রনাথকেই নির্বাচন করেছিলেন।
অসাধ্য সাধন হয়েছিল, শিষ্য তার বিস্ময়কর শক্তিতে কপর্দকহীন হয়েও প্রিয় প্রভুর নামাঙ্কিত যে আন্দোলন ও সদ্য তৈরি করলেন ভারতবর্ষের ইতিহাসের তা প্রথম। ভগবান বুদ্ধের ভুবনবিজয়ের পর যেন এই প্রথম ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটল, দেশ দেশ নন্দিত করে মন্দ্রিত হল বৈপরীত্যে ভরা এক বিস্ময়কর ব্রাহ্মণের বাণী, যিনি নৈষ্ঠিক পুরোহিত হয়েও নিজের কাজের জন্য নির্বাচন করে গেলেন এক কায়স্থ সন্তানকে। এদেশের ইতিহাসে একটা অসম্ভব ঘটনা ঘটে গেল।
ম্যানেজমেন্ট শাস্ত্রবিদরা অকারণে অষ্টোত্তর শতনামে মুখরিত হওয়ায় বিশ্বাস করেন না। প্রশস্তির সঙ্গে তারা সমালোচনাও করে থাকেন। তাদের শাস্ত্রীয় বিশ্বাস, বিধাতার এই সৃষ্টিতে ‘পারফেকশন’ অথবা নিখুঁত বলে কিছুই নেই, যা আছে তা কেবল পারফেকশনের সন্ধান–নিরন্তর সন্ধান।
শ্রীরামকৃষ্ণের প্রধান চেলাটি বয়সে তার থেকে পঁচিশ বছরের ছোট–তাঁর জন্ম ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৮৩৬ আর নরেন্দ্রনাথের ১২ জানুয়ারি ১৮৬৩। ১৬ আগস্ট ১৮৮৬ মধ্যযামিনীতে কাশীপুর উদ্যানবাটিতে যখন তাঁর জীবনলীলা সাঙ্গ হল তখন প্রধান শিষ্যের বয়স মাত্র তেইশ, প্রবল প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যে নবীন এক সন্ন্যাসীকুলের সৃষ্টি হল, তারপর ভাগ্যসন্ধানে বিশ্বপরিক্রমা এবং অবশেষে কয়েক হাজার বছরের শিক্ষা ও অভিজ্ঞতার আলোকে তুলনাহীন এক সন্ন্যাসীসঙ্ঘের সৃষ্টি যার নাম রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন।