বিশ্বনাথ একসময় স্ত্রীর নামে সুন্দরবনে এগারো হাজার বিঘার বিস্তৃত তালুক কেনেন। কিন্তু খুড়শ্বশুর কালীপ্রসাদ তার ভ্রাতুষ্পত্রের বধূকে বলেন ‘তোমার কি বাবার তালুক’। ভূবনেশ্বরী বেশী কথা বলতেন না। এই গালি শুনে নরেন্দ্ৰজননী সম্পত্তির পাট্টাটি মাটিতে ছুঁড়ে ফেলে দেন। আমরা জানি, বিশ্বনাথ পরে বুঝতে পারেন তার স্ত্রীর দুঃখ, পীড়া ও বেদনা। তিনি ক্ষুব্ধচিত্তে একদিন প্রকাশ করলেন অভিযোগ, “আমি এত টাকা রোজগার করি, আর আমার স্ত্রী পেটভরে খেতে পায় না।”
এসব বলা সত্ত্বেও বিশ্বনাথ যৌথ পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চাননি, ফলে ভূবনেশ্বরীর কষ্ট শেষ হয়নি। কিন্তু যা ঘটবার তা ঘটল যথাসময়ে। পারিবারিক সম্পত্তির ন্যায্য অংশ থেকে বঞ্চিত করার জন্য কাকার পরিবার বিশ্বনাথকে পৃথক করে দিলেন। এই সময়ে তিনি সাময়িকভাবে সপরিবারে ৭ ভৈরব বিশ্বাস লেনের ভাড়াবাড়িতে উঠে যান।
প্রায় একই পরিস্থিতিতে সুলোচনা উপন্যাসের যৌথপরিবারে কী হল এবং কীভাবে জটীল সমস্যার অপ্রত্যাশিত সমাধান হল তা এখানে ফাঁস করতে চাই না, তাতে উপন্যাসপাঠের আনন্দ ও আকর্ষণ কমে যেতে পারে। শুধু এইটুকু বলতে চাই যে গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটের বাড়িতে বসে একজন কথাসাহিত্যিক যে কাল্পনিক উপন্যাস লিখছেন তার প্রায় সমস্ত উপাদান সংগৃহীত হচ্ছে একই বাড়ির বাস্তবতা থেকে।
শুভার্থিনী ক্ষমা দিদি সুলোচনাকে চুপি চুপি বলছেন, “তুই বলে এই ঘর করিস, আমরা হলে এতোদিনে কাপড় ফেলে পালাতুম।”
এরপরে ক্ষমাদি খবর দিচ্ছেন, “রাম বলেছে বেশি টাকা না পাঠিয়ে তোমার নামে একখানা তালুক কিনবে।”
সুলোচনার উত্তর : “তালুকের নাম শুনে তো আমার পেট ভরবে না।…বাপের এক মেয়ে বটে কিন্তু রোজ রোজ কে আব্দার শুনবে গা! লোক বলে, তুই বড় মানুষের মেয়ে, বড় মানুষের বউ, তোর দশা এমন কেন? তোর ভাবনা কিসের? লোকে তো ঘরের কথা জানে না তা বলবো কি বলল। রোজ রোজ বাবাকে কত বলে পাঠাবো বলো–আবার তিনি মনে করেন তাঁর মেয়ে কত সুখে ভাসছে।”
বিশ্বনাথ এই ডায়ালগে রামতনু বসু লেনে নিজের শ্বশুরবাড়ির কথা বলেছেন কিনা তা পাঠক-পাঠিকারা বিবেচনা করে দেখবেন। কুঞ্জবিহারী দত্তর জ্যেষ্ঠা কন্যা রাইমণি, তার স্বামী গোপালচন্দ্র ঘোষ। গোপালচন্দ্রের একমাত্র সন্তান রঘুমণি। এঁর স্বামী নন্দলাল বসুই বিশ্বনাথের শ্বশুর। ‘সুলোচনা’ উপন্যাসে রামহরির শ্বশুরের নাম নিধিরাম সরকার। তিনি সম্মৌলিক কায়স্থ।
ক্ষমাদিদি মারফৎ দুঃখিনী সুলোচনা তার প্রবাসী স্বামীর কাছে যে খবর পাঠিয়েছিলেন তা আমাদের এই তুলনামূলক আলোচনার পক্ষে তাৎপর্যপূর্ণ।”যদি তিনি আমাদের জ্যাস্ত দেখতে চান একবার যেন ফিরে আসেন–তার যক্ষের ধন নিয়ে কি স্বর্গে যাবো?”
সুরসিকা মাদিদির প্রতিশ্রুতি তিনি রামহরিকে খবর পাঠাচ্ছেন– “জনকনন্দিনী ধুলোয় পড়ে লুটোপুটি খাচ্ছেন– এইবার বুঝি সীতা ঠাকরুণ প্রাণত্যাগ করেন।”
উপন্যাসকে অবলম্বন করে বাস্তবের ছবি আঁকা অপরাধ না হলে, বিশ্বনাথ তাঁর উপন্যাসে রামহরির তরুণ পুত্র সুরথনাথের যে বর্ণনা দিয়েছেন তা কৌতূহলের উদ্রেক করে। সুদীর্ঘকায় কিন্তু কৃষ অথচ বাহুদ্বয়ের ও উরুদেশের অস্থি স্থূল ও সবল। গৌরাঙ্গ, মস্তকটি সুগঠিত ও সুগোল। ঘোর কৃষ্ণবর্ণ কোমল কেশাবৃত ললাট প্রশস্ত ও সুবিস্তারিত। যুগল সুব ধনুকের ন্যায় ঘন কেশরঞ্জিত, নেত্রদ্বয় সুদীর্ঘ ও ভাসমান।…গ্রীবা সমুন্নত ও স্কন্ধদ্বয় সুবিস্তারিত, দুই বাহু লম্বমান করিলে প্রায় দুই জানু স্পর্শ করিত। সুরথনাথের বয়স বোড়শ বর্ষ। ঠিক যে বয়সে স্বয়ং বিশ্বনাথ বিবাহ করেছিলেন উত্তর কলকাতার রামতনু বসু লেনের ভূবনেশ্বরীকে।
.
উপন্যাসে বসু পরিবারের ছেলেপুলেদের নামগুলি মজার–’ছেঁড়া’, ‘ভাঙ্গা’, ‘গোঁড়া, ‘খেঁদি’, ‘ভূতী’, ‘পদী’, ইত্যাদি।
পরবর্তী পর্বে রামহরি দেশে ফিরেছেন, সুলোচনা ফোঁস ফোঁস করে কেঁদে নিজের দুঃখের কথা বলতে লাগলেন।”ছেলেটির হাত ধরে পথের ভিখারিনী হয়ে বেড়াব?”
রামহরি তখনও যৌথপরিবারে বিশ্বাস হারাননি। “দেখো মেজো বউ, লোকে তোমার কথা শুনলে বলবে তুমি ঘর ভাঙতে চাও, আর তুমি দাদার ছেলেমেয়ের হিংসা করো। না হলে তোমার কান্নাকাটির কোনো কারণই তো দেখতে পাইনে।”
বিবেকানন্দপিতার উপন্যাসের সুবিশাল অংশ জুড়ে রয়েছে পুত্র সুরথনাথের বিবাহবর্ণনা।
উনিশ শতকের মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারে বিবাহ উপলক্ষে যে বেহিসেবী কাণ্ডকারখানা চলত তার হৃদয়গ্রাহী কিন্তু নির্ভরযোগ্য বর্ণনা পাওয়া যাচ্ছে। এই বিবাহবাসরের সঙ্গে স্বয়ং বিশ্বনাথের বসুপরিবারে বিবাহের তুলনীয় কিছু আছে কি না তা এতদিন পরে কারও পক্ষে আন্দাজ করা সম্ভব নয়; তবে পাঠকপাঠিকারা মানসচক্ষে একটা ধারণা করে নেবার স্বাধীনতা অবশ্যই দাবি করতে পারেন।
যাঁরা কল্পনার সঙ্গে ঘটনাকে মিলিয়ে দেখবার জন্য সব সময় তেমন ব্যস্ত নন তারা বুঝতে পারবেন, নানা পারিবারিক উৎসবের ঘূর্ণিপাকে স্বেচ্ছায় জড়িয়ে পড়ে অষ্টাদশ, উনিশ ও বিশ শতকের বাঙালি কেন অর্থসঞ্চয় করতে ব্যর্থ হয়েছে এবং কোন পরিপ্রেক্ষিতে স্বামীজি বলেছিলেন, যারা কখনও লাখ টাকার ওপর বসলো না তারা কেমন করে বৈরাগ্যে আগ্রহী হবে?