অভিজ্ঞ আইনজীবী হয়েও বিশ্বনাথ কোনো উইল করেননি। ফলে মক্কেলদের কাছ থেকে পাওনাগণ্ডা আদায়ের জন্যও ভূবনেশ্বরী ও নরেন্দ্রনাথকে উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হতে হয়েছিল। সময় ও অর্থব্যয় হলেও এর একটা সুবিধা আমরা পেয়েছি, হাইকোর্টে ভূবনেশ্বরীর আবেদনপত্রে ভূবনেশ্বরী দাসীর বাংলা স্বাক্ষর এবং তার তলায় ইংরিজিতে পুত্র নরেন্দ্রনাথের স্বাক্ষরের অমূল্য দলিলটি, যা আজও কলকাতা হাইকোর্টে সংরক্ষিত আছে।
১১ আগস্ট ১৮৮৬তে লেটার্স অফ অ্যাডমিনিসট্রেশনের এই আবেদনে ভূবনেশ্বরী বলেন, মৃত্যুর আগে তাঁর স্বামী কোনো উইল করেননি। এইরকম কোনো দলিল তার অফিসে বা বাড়িতে খুঁজে পাওয়া যায়নি। এই আবেদনের সময় নরেন্দ্রনাথের বয়স বাইশ, অন্য দুই ভাই নাবালক। বিশ্বনাথের কয়েকজন মক্কেল যাঁদের কাছে টাকা পাওনা আছে তাদের নাম ঠিকানার বিবরণ এই আবেদনে আছে। তাদের নিয়ে কোনো অনুসন্ধান আজও হয়নি।
আবেদনপত্রে মায়ের বাংলা স্বাক্ষর সনাক্ত করে পুরো নাম সই করেন নরেন্দ্রনাথ। জানান, মায়ের দরখাস্ত তিনি পূর্ণ সমর্থন করছেন। এই মামলায় ভূবনেশ্বরীর অ্যাটর্নি ছিলেন সুরেন্দ্রনাথ দাস, ভুবনেশ্বরীকে সনাক্ত করেন কালীচন্দ্র দত্ত এবং ইংরিজি অনুবাদের বাংলা ব্যাখ্যা করে শোনান অবিনাশচন্দ্র ঘোষ, ইনটারপ্রেটার।
*
ঔপন্যাসিক বিশ্বনাথ সুলোচনার উপাদান কতখানি নিজের পরিবার থেকে সংগ্রহ করেছেন? নায়কের আদিপুরুষদের কথা বলতে গিয়ে মূলগায়িন’ বলে একটি শব্দ বিশ্বনাথ ব্যবহার করেছেন।
দত্তরা এসেছিলেন বর্ধমান জেলার কালনা মহকুমার দত্ত-দরিয়াটোনা থেকে, চলতি ভাষায় কোথাও দেরেটোন, কোথাও দাড়িয়াটোন। দরিয়াটোনার দত্তরা মুঘল আমল থেকেই বিখ্যাত, দক্ষিণ-রাঢ়ী কায়স্থদের যে ত্রিশটি সমাজ ছিল দরিয়াটোনার দত্তরা তাদের অন্যতম। কোনো নবাব বাহাদুর প্রীত হয়ে গ্রামের নাম দত্ত-দরিয়াটোনা বলে ঘোষণা করেন। স্বামীজির পূর্বপুরুষ রামনিধি এই দত্ত-দরিয়াটোনা থেকে কলকাতায় এসে গড়-গোবিন্দপুরে বসবাস শুরু করেন।
বিশ্বনাথের উপন্যাসের নায়ক রামহরির ঠিকানা : শৰ্ষা গ্রাম, জয়পুর পরগণা, জেলা নবদ্বীপ। আদিপুরুষ কেনারাম বসু, যাঁর সম্বন্ধে পাঠক পাঠিকারা ইতিমধ্যেই কিছুটা জানতে পেরেছেন। কেনারামের একটি উক্তি থেকে লেখকের মনোভাব কিছুটা আন্দাজ করা যায় : “বাপের নাম জানিনে। পিতামহের নাম জানিনে কিন্তু চিনের বাদশার চোদ্দপুরুষের পরিচয় জানবার জন্য ব্যগ্র!”
কেনারাম বসুর জ্যেষ্ঠপুত্ৰ উপন্যাসের অন্যতম চরিত্র ভজহরি তেরোটি পুত্রকন্যার পিতা। নায়ক রামহরি দ্বিতীয়পুত্র, তার একটি মাত্র সন্তান সুরথনাথ। অসামান্যা স্ত্রী সুলোচনার নামেই উপন্যাসের নামকরণ। সুলোচনার পিছনে কি বিবেকানন্দ গর্ভধারিণী উঁকি মারছেন? না বিশ্বনাথ জননী শ্যামাসুন্দরী? ব্যক্তিজীবনে শ্যামাসুন্দরীর একটি মাত্র পুত্র; ভূবনেশ্বরী চারপুত্র ও ছয়কন্যার জননী।
‘সুলোচনা’ উপন্যাসে নায়ক রামহরি ও সুলোচনার একমাত্র পুত্র সুরথনাথ। চরিত্রটির ওপর লেখক সব ভালবাসা ঢেলে দিয়েছেন। একমাত্র সন্তানকে পৈত্রিক বাড়িতে স্ত্রীর কাছে রেখে রামহরি বসু একদা কর্মসন্ধানে দিল্লি পাড়ি দিয়েছিলেন।
বাড়ির কর্তা ভজহরি বসু সবসময়েই এত ব্যস্ত যে “মাথা চুলকাইবার” অবকাশ হতো না। এইপ্রসঙ্গে লেখকের ব্যঙ্গোক্তি : “শয্যা হইতে গাত্রোত্থান, নিত্যক্রিয়া সমাপন, মুহুর্মুহু তাম্রকুট ধূমপান, দণ্ডে দণ্ডে তীব্র মুখব্যাদান করিয়া হায়ি তোলা ইত্যাদি কর্মসমূহ একজন পুরুষের পক্ষে সাধ্য নহে।”
বসুদের যৌথ পরিবারে দু’জন গুরুত্বপূর্ণ কর্মীনশীরাম গুরুমহাশয় ও ভোলো খানসামা। মুহুরি নশীরাম কেনারামের রেখে যাওয়া সম্পত্তির দেখভাল করতেন ও পাওনা টাকা আদায় করতেন। রেগে গেলে তিনি ভজহরিকে বলতেন, “আমি না থাকলে তোমার প্রত্যহ চারকাটা মুড়ি, দুরেক চালের ভাত কোথা থেকে হবে?”
রামহরি যেমন লেখাপড়ায় পটু তেমনি নম্র ও সুশীল। সাহেবী কোম্পানিতে একটা সামান্য কাজ নিয়ে প্রবাস যাত্রার উদ্যোগ করেছিলেন।
বিদায়কালে দাদা ভজহরিকে প্রণাম করে রামহরি অন্তঃপুরে গেলেন এবং দেখলেন প্রিয়তমা ভার্যা ধুলোয় পড়ে অশ্রুনয়নে ক্রন্দন করছেন, আর মাঝে মাঝে দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করছেন। সেকালের বাঙালি পরিবারের যেসব পুরুষ কর্ম উপলক্ষে বিদেশ যেতেন তাদের মানসিক অবস্থার একটা চমৎকার ছবি এই উপন্যাসে পাওয়া যাচ্ছে। রামহরি তার স্ত্রীকে প্রিয়পুত্র সুরথনাথের লেখাপড়ায় নজর রাখতে বললেন, সেই সঙ্গে বললেন, “আমি দাদার কাছে টাকা পাঠাবো। আর তোমার জন্যে লুকিয়ে প্রহ্লাদ সেনের (বন্ধু) কাছেও টাকা পাঠাব।”…বন্ধুর বিধবাভগ্নী “ক্ষমাদিদি এসে তোমার হাতে টাকা দিয়ে যাবে।”…পত্নী সুলোচনা আবার ধুলোয় লুটিয়ে কাঁদতে লাগলেন।
প্রবাসে রামহরি যে কাজ করতেন তার মাইনে তেমন বেশি নয়। নায়ক ভাবছেন, এতো কম অর্থের জন্যে কেন বিদেশে আসা? বিশ্বনাথ যে তার নিজস্ব প্রবাসজীবনের অভিজ্ঞতা এইখানে বেশ ভালভাবে কাজে লাগিয়েছেন তা স্পষ্ট।
এই সময় একদিন দিল্লির প্রসিদ্ধ বণিক রঘুরামজী কুঠিওয়ালার সঙ্গে রামহরির যোগাযোগ।