পরবর্তী সময়ে স্বামীজির মা অল্পবয়সী স্বামীর এই কাজকে সমর্থন করতেন। তার ধারণা ছিল, মামাকে লিখে না দিলে, দত্তবাড়ির শরিকরা এই সম্পত্তি বিশ্বনাথের কাছ থেকে হাতিয়ে নিতেন।
মধু রায় লেনে সিমুলিয়ায় দত্তপরিবারের একটা যৌথ সম্পত্তি ছিল। কালীপ্রসাদের অনুরোধে বিশ্বনাথ এই সম্পত্তিতে তার ভাগটা কাকাকে লিখে দিয়েছিলেন। স্বভাবতই ভূবনেশ্বরী প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছিলেন, এইভাবে সব সম্পত্তি লিখে দিলে নিজের ছেলে, মেয়ে, বউয়ের জন্যে কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না।
কিন্তু সংসারবিরাগী বাবার অনুপস্থিতিতে যে কাকা তাকে ছোটবেলায় মানুষ করেছেন তার প্রতি বিশ্বনাথের আনুগত্য ছিল প্রশ্নহীন। ছোট বয়সে যিনি আমাকে দেখেছেন তিনি চাইলে দেহের মাংস পর্যন্ত কেটে দিতে পারি, এই হল কৃতজ্ঞ বিশ্বনাথের মনোভাব।
কাকার দেহাবসান পর্যন্ত বিশ্বনাথের এই মানসিকতার কোনো পরিবর্তন হয়নি। কিন্তু মৃত্যুর কয়েক বছর আগে থেকে তিনি বড়ছেলে নরেনের কাছে নিজের মনের কথা লুকিয়ে রাখেননি, গভীর দুঃখের সঙ্গে তিনি বর্ণনা করতেন, কাকা এবং তার পরিবারের কাছে তিনি কীভাবে নিগৃহীত ও অত্যাচারিত হয়েছিলেন। ‘সুলোচনা’ উপন্যাসের পাঠক বসুপরিবারের তিন পুত্রের জ্যেষ্ঠ ভজহরির মধ্যে সিমুলিয়ার গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটের কালীপ্রসাদকে খুঁজে পেলেও পেতে পারেন।
*
বিশ্বনাথ দত্তের উপন্যাসটি একটি কায়স্থ পরিবারকে কেন্দ্র করে। এই উপন্যাসের প্রথম পুরুষ কেনারামও অনেকটা দত্ত পরিবারের রামমোহনের মতন। ইনিও ছিলেন আধা-উকিল। উপন্যাসের কেনারাম আইনের ব্যাপারে কখনও কাউকে কুপরামর্শ দিতেন না, কেউ এমন কথা বলতে পারত না যে কেনারামের পরামর্শে তার ক্ষতি হয়েছে। এই কেনারামও রামমোহনের মতন বুদ্ধি ও কৌশলে নিজের পৈতৃক ভদ্রাসনের সুবিস্তার ঘটিয়েছিলেন।
আরও এক আশ্চর্যজনক সাদৃশ্য। দত্তপরিবারের প্রথম চারপুরুষ সকলেই রাম রামনিধি, রামজীবন, রামসুন্দর, রামমোহন। আর বিশ্বনাথের লেখা উপন্যাসের আদিচরিত্র কেনারাম ও প্রধান চরিত্র রামহরি।
পিতৃদেব কেনারাম বসুর আশি বছর বয়সে মৃত্যুর সময় জমিজমা বাগবাগিচা ও তালুক ছাড়াও নগদ নিতান্ত কম ছিল না। তাছাড়া সম্পত্তির বাৎসরিক আয় পঞ্চাশ হাজার টাকা এমন এক সময়ে যখন বাৎসরিক চার হাজার টাকা আয়ের লোকরা নিজেদের বড়মানুষ বলে গণ্য করতেন।
‘সুলোচনা’ উপন্যাসের কোন চরিত্রের মধ্যে লেখক বিশ্বনাথ দত্ত লুকিয়ে আছেন? উপন্যাস শেষ করে পাঠক-পাঠিকারা অবশ্যই তাদের নিজস্ব সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারবেন। আপাতত বলা যেতে পারে, একটি নয়, দুটি চরিত্রে তার ব্যক্তিজীবনের ঘটনাবলি বারবার উঁকি মারছে। একটি অবশ্যই নায়ক রামহরি–সেই চরিত্রে আছে তার জীবনসংগ্রাম ও নানা সংঘাত। গল্প একটু এগোলেই কিন্তু মনে হয়, রামহরির একমাত্র সন্তান সুরথনাথের মধ্যেও লেখক বিশ্বনাথ উঁকি মারছেন। বিশ্বনাথের বাল্য, যৌবন ও জীবনসায়াহ্নের ঘটনাবলি একটু বিস্তারিত জানা থাকলে চরিত্ৰবিচার সহজতর হতে পারে।
*
বাল্যে বিশ্বনাথের লেখাপড়া নিয়ে দত্ত পরিবারের কেউ তেমন মাথা ঘামাননি। পাড়াপড়শিদের প্রশ্নে ধৈর্যহীন হয়ে নিজের মুখরক্ষার জন্য অনাথ ভ্রাতুস্পুত্রকে অবশেষে কালীপ্রসাদ পাঠিয়েছিলেন আজকের ওরিয়েন্টাল সেমিনারিতে, সেকালে যার নাম ছিল গৌরমোহন আঢ্যর স্কুল। বালকটির জুতো ছিল না, খালিপায়ে প্রতিদিন সিমলা থেকে আহিরিটোলায় যাতায়াত করতে হত। এক মাস্টারমশায় জিজ্ঞেস করলেন, জুতো নেই কেন?
সরলমনে গরিব ছেলেটি উত্তর করল, “আমার বাবা বারাণসীতে থাকেন। তিনি আমার জন্যে জুতো পাঠাবেন। এখনও জুতো আসেনি, এলেই পরবো।” আমরা জানি পিতা দুর্গাপ্রসাদ তখন বারাণসীতে মঠাধীশ। গৌরমোহন আঢ্যের ইস্কুলেই বিশ্বনাথের শিক্ষক ছিলেন রসিকচন্দ্র চন্দ্র। বিধির বিধানে পরবর্তীকালে এঁরই পুত্র কালীপ্রসাদ চন্দ্র স্বামী অভেদানন্দ নামে বিখ্যাত হয়েছিলেন। কালীবেদান্তি ছিলেন স্বামীজির প্রিয়বন্ধু ও গুরুভাই। স্বামীজি তাঁর এই গুরুভাইকে আমেরিকায় বেদান্ত প্রচারের জন্য আহ্বান করেছিলেন।
‘জুনিয়র’ ও ‘সিনিয়র’ পরীক্ষা পেরিয়ে কোনো এক সময়ে বিশ্বনাথ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েট হলেন। পরবর্তী ঘটনাবলি কিছুটা ধোঁয়াশায় ঢাকা। কনিষ্ঠপুত্ৰ ভূপেন্দ্রনাথ জানিয়েছেন, অর্থোপার্জনের জন্য বিশ্বনাথ কিছুদিন ব্যবসায়ে হাত পাকিয়েছিলেন, কিন্তু তেমন সুবিধে করতে পারেননি।
পরবর্তী পর্যায়ে তার ওকালতিজীবনও আমাদের আয়ত্তের বাইরে থেকে যেত। কিন্তু কলকাতা হাইকোর্টের মাননীয় প্রধান বিচারপতি ফণীভূষণ চক্রবর্তী উচ্চ আদালতের রেকর্ড ঘেঁটে কিছু আলোকপাত করে গিয়েছেন। আর আছে কলকাতা হাইকোর্টে বিশ্বনাথের বিধবা ভূবনেশ্বরী দাসীর আবেদনপত্র যেখানে মায়ের সঙ্গে সই করেছেন স্বয়ং নরেন্দ্রনাথ দত্ত। এই আবেদনের তারিখ কলকাতায় সুলোচনা প্রকাশের প্রায় সাড়ে চার বছর পরে।
মামলা মোকদ্দমার ছায়া থেকে সিমুলিয়ার দত্তরা কখনও নিজেদের দূরে সরিয়ে রাখতে পারেননি। সন্ন্যাসী দুর্গাপ্রসাদের বিষয়-সম্পত্তি অধিকারের জন্য হাইকোর্টের মামলায় দীর্ঘ বারো বছর তার কোনো সংবাদ বা সন্ধান না পাওয়ার অভিযোগে তাঁকে আইনমতে মৃত ঘোষণা করা হয়েছিল।