বকাবকি করতেন, মান অভিমান হতো অসুস্থ শরীরে। কিন্তু যাকে যত ভালবাসতেন তাকে তত বকতেন এবং গাল দিতেন।
স্বামীজি একবার বেলুড়মঠে নিয়ম করেছিলেন যে, কেউ দিবানিদ্রা যেতে পারবে না। একদিন ঘুরে দেখেন স্বামী প্রেমানন্দ ঘুমোচ্ছেন। স্বামীজি তখনই এক শিষ্যকে নির্দেশ দিলেন, যা তাকে পা ধরে টেনে ফেলে দিতে। টানাটানিতে নিদ্রাভঙ্গ হয়ে প্রেমানন্দ বললেন, আরে থাম থাম করিস কি। ঐদিন সন্ধ্যায় ঠাকুরের আরতির পর স্বামী প্রেমানন্দ ঘরের সামনের বারান্দায় উত্তর দিক দিয়ে ঐ স্থানে প্রবেশ করলেন, তখন স্বামীজি পায়চারি করছিলেন। গুরুভাইকে দেখে স্বামীজি তার চরণযুগল জড়িয়ে দরবিগলিত নেত্রে বলতে লাগলেন, “আমি তোদের সঙ্গে কি অন্যায় অত্যাচার না করছি।” এই বলে তিনি বালকের ন্যায় ক্রন্দন করতে লাগলেন। স্বামী প্রেমানন্দ সেদিন যে বহুকষ্টে তাকে শান্ত করতে সক্ষম হয়েছিলেন তা আমরা স্বামী চন্দ্রেশ্বরানন্দের স্মৃতিকথা থেকে জানতে পারি।
স্বামীজির কাছে ছাড় কেউই পেত না। আমেরিকা ফেরত স্বামী সারদানন্দ দেশে ফিরে সর্বদা ফিটফাট পরিষ্কার থাকতেন। একদিন হরি মহারাজের (স্বামী তুরীয়ানন্দ) মাদুরে জুতো পরে বসে আছেন। স্বামীজি যথাসময়ে ধমক দিলেন, “হারে সারদা ওরা (আমেরিকাবাসীরা) কি তোকে গ্রাস করেছে। কিছু কি শুকিয়ে দিয়েছিল যে একেবারে সব ব্যাপারে ওদের মতো হয়ে গেছিস?”
যার উপর স্বামীজি সবচেয়ে বেশি নির্ভর করতেন, তার অবর্তমানে যাঁর ওপর স্বামীজি মঠের দায়িত্ব অর্পণ করে নিশ্চিন্ত হয়েছিলেন, সেই আবাল্যবান্ধব রাজা মহারাজ বা স্বামী ব্রহ্মানন্দের ব্যাপারটা শুনুন। তার সঙ্গে স্বামীজির চিকিৎসা সংবাদ। তার পা ফুলেছে। সমস্ত শরীরে জলসঞ্চার হয়েছে। গুরুভাইরা বড়ই চিন্তিত। স্বামীজি অবশেষে কবিরাজী ওষুধ খেতে রাজি হয়েছেন।
“শিষ্য : মহাশয়, এই দারুণ গ্রীষ্মকাল। তাতে আবার আপনি ঘণ্টায় চার-পাঁচ বার করে জলপান করেন। এ সময়ে জলবন্ধ করে ওষুধ খাওয়া আপনার পক্ষে অসহ্য হবে।
“স্বামীজি : তুই কি বলছিস? ঔষধ খাওয়ার দিন প্রাতে আর জলপান করব না’ বলে দৃঢ় সংকল্প করব। তারপর সাধ্যি কি জল আর কণ্ঠের নিচে নাবেন। তখন একুশ দিন জল আর নীচে নাবতে পারছেন না। শরীরটা তো মনেরই খোলস।”
শরীরের ওপর এই নিষ্ঠুর শাসন শেষ পর্যন্ত সম্ভব হয়েছিল, যদিও চিকিৎসায় কী সাফল্য এসেছিল তা সন্দেহজনক।
তবে সারাজীবন ধরে শরীরকে কত যন্ত্রণা যে সহ্য করতে হয়েছে তার শেষ নেই। স্বামীজি নিজেই বলেছেন, পরিব্রাজক জীবনে এক-আধদিন উপবাস করাতে তিনি উপেক্ষাই করেছেন। তবে কখনও তিনদিনের বেশি উপবাস করতে হয়নি। সেই সময় একবার বাঘে খেয়ে ফেলুক ভেবে বনে বসেছিলেন। বাঘ কিন্তু ফিরে চলে গেল দেখে দুঃখিত হয়ে বললেন, বাঘেও খেল না।”
অসুস্থ শরীরের কথায় ফিরে আসা যাক। ডায়াবেটিস, বিনিদ্রা, হার্টের ট্রাবল নিয়ে কলকাতায় ফিরে এসে তাকে বড় ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হয়েছিল।
যুগনায়ক বিবেকানন্দ গ্রন্থে স্বামী গম্ভীরানন্দের সংযোজন : এর কিছুদিন পরেই দেওঘরে স্বামীজির জীবন সংকটাপন্ন। “সময় সময় এত শ্বাসকষ্ট হইত যে মুখ-চোখ লাল হইয়া উঠিত এবং উপস্থিত সকলে মনে করিতেন, জীবন বা প্রাণবায়ু নির্গত হইয়া যাইবে। স্বামীজী বলিতেন, এই সময় একটি উঁচু তাকিয়ার উপর ভর দিয়া বসিয়া মৃত্যুর জন্য প্রতীক্ষা করিতেন।”
সমকালের অবজ্ঞা অপমান বিবেকানন্দকে স্পর্শ করতে পারেনি, কিন্তু তার শরীরের অবনতির পরে তার যত কিছু মান-অভিমান ও বকাবকি সব তার প্রিয় গুরুভাই ও শিষ্যদের প্রতি। তবে শুধু বকেননি, দিয়েছেনও নিজেকে উজাড় করে।
স্বামীজির রাগ যাঁদের উপর গিয়ে পড়ত তাদের অবস্থা কিরকম হত? স্বামী ব্রহ্মানন্দ একবার বলেছিলেন, “তার বকুনি সহ্য করতে না পেরে আমারই কতবার মনে হয়েছে মঠ ছেড়ে চলে যাই।”
শেষের সময় আর সুদূর নয়। স্বামী অখণ্ডান লিখেছেন, “স্বামীজি শেষটায় মানুষের সঙ্গে ব্যবহারে হতাশ হয়ে জীবজন্তু নিয়ে থাকতেন। তার অনেক হাঁস, পায়রা, কুকুর বেড়াল, ভেড়া ইত্যাদি ছিল। দস্তুরমতো একটা চিড়িয়াখানা তৈরি করেছিলেন। নিজের সেবার টাকা থেকে তাদের জন্য দেড়শ টাকা খরচ করতেন। তাঁর হাঁসের মধ্যে চীনে, বম্বেটে, পাতিহাঁসও ছিল। কুকুরের নাম মেরি, টাইগার। ভেড়ার নাম মটরু। চীনে হাঁসের নাম যশোমতী রেখেছিলেন। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় স্বামীজির দেহরক্ষার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর পশুপাখী সব মরে যায়। তিনি যাকে যা দিয়ে গিয়েছিলেন, তার একটিও বেশি দিন বাঁচেনি।” স্বামীজির দেহরক্ষার পরে খোকা মহারাজ (স্বামী সুবোধানন্দ) কয়েকটি পশুপাখি অখণ্ডানন্দকে দিয়েছিলেন। একটি বেড়াল স্বামীজির পায়রাটিকে লুকিয়ে খায়। স্বামী শঙ্করানন্দ সেই সময় আশ্রমে ছিলেন। তিনি বেড়ালটাকে এমন ঘুষি মেরেছিলেন যে, তার হাত থেঁতলে গিয়েছিল।
বড় চুপি চুপি এলো ৪ঠা জুলাই ১৯০২। স্বামীজির অসুস্থতা ছিল, কিন্তু কেউ বোঝেনি যে সময় সমাগত। প্রায় বিনা নোটিসেই তিনি চলে গেলেন। যাবার তিনদিন আগে আকারে-প্রকারে জানিয়ে দিয়ে গেলেন কোথায় তার শেষকৃত্য সম্পন্ন করতে হবে।