এরপর সহাস্য স্বামীজির সেই বিখ্যাত ডায়ালগ : “দুঃশালা হোঁকা, উঠে বোস! শালার ম্যালেরিয়া জ্বর হয়েছে কিনা তাই গতিকে কি কচ্ছে দেখ! যা শালা তোকে লেকচার করতে হবে না, না হলে তোকে মারব লাথি আর এই চারতলার জানলা থেকে রাস্তায় ফেলে দোব। শালা তোকে ওয়ার্ক হাউসে খাটাব। জানিস না কত খরচ হয়েছে।”
শুধু সারদানন্দ নয়, নিজের ভাইয়ের সঙ্গেও স্পেশাল স্টাইলে কথা বলতেন স্বামীজি। লন্ডনে তিনি চেয়েছিলেন ব্যারিস্টারি না পড়ে ভাইও সারদানন্দ ও গুডউইনের সঙ্গে আমেরিকা পাড়ি দেয়। অনুগত ভক্ত ও ক্ষিপ্রলিপিকার গুডউইন যেমন স্বামীজি একটু ঘরের বাইরে গেছেন অমনি নকল করে মহিমকে বলতে লাগলেন, “মারব ঘুষি দাঁত ভেঙ্গে দেব, নাক ভেঙ্গে দেব। চ’ আমেরিকায়। তিনজনে মিলে যাব।”
এসবের মধ্যে রাগ যতটুকু আছে তার থেকে মজা অনেক বেশি। জীবনের প্রধান সময়টুকুই ছিলেন স্বামীজি মজার মানুষ। স্বামী অখণ্ডানন্দ তাই বারবার বলছেন, “তার রাগ একেবারেই ছিল না। তিনি ছিলেন অক্রোধপরমানন্দ।”
রাজপুতনার এক নাপিত স্বামী অখণ্ডানন্দকে বলেছিলেন, “মহারাজ, আপনাদের স্বামীজির তুলনা নেই। অমন ক্রোধ সংবরণ করতে কাউকে দেখিনি। পণ্ডিত তাঁকে বিচারে পরাস্ত করতে এসেছে, অপমানসূচক উত্তর দিচ্ছে আর তিনি মুচকি মুচকি হেসে তার উত্তর দিচ্ছেন। শেষে, যারা তার নিন্দা করতে এসেছিল তারাই তার গোলাম হয়ে গেল।”
রোগে জর্জরিত এই মানুষটিই শেষ জীবনে কি রকম অসহায় হয়ে উঠেছিলেন, কেমনভাবে তার ধৈর্যচ্যুতি ঘটতে তার বিবরণ প্রিয়শিষ্য স্বামী শুদ্ধানন্দ ও স্বামী অচলানন্দ (স্বামীজির শেষ সন্ন্যাসী শিষ্য) কিছু কিছু রেখে দিয়েছেন। স্বামীজির প্রধান সমস্যা নিদ্রাহীনতা। একবার তিনি কনিষ্ঠতম শিষ্যকে বললেন, “বাবা, তুই আমাকে ঘুম পাড়িয়ে দিতে পারিস? তুই যা চাস, তোকে আমি তাই দেব।” তখন তার নিদ্রা হলেও শারীরিক গ্লানি যথেষ্ট। স্বামীজি বললেন অচলানন্দকে, “জ্ঞান হওয়ার পর থেকে আমি জীবনে কখনও চার ঘণ্টার বেশি ঘুমাইনি।” যখন তিনি একথা বলছেন তখন তার চোখে একেবারেই ঘুম নেই।
স্বামী অচলানন্দ বলেছেন, অসুস্থ স্বামীজি যখন উগ্রমূর্তি ধারণ করতেন তখনও তার মধ্যে একটা মাধুর্য থাকতো। আরও একটা বৈশিষ্ট্য, ক্রোধের পর মুহূর্তেই তার উগ্রভাব চলে যতো, আবার সেই প্রেমপূর্ণ মধুর ভাব আত্মপ্রকাশ করতো। কেউ বুঝতো না যে তিনি একটু আগেই রেগে গিয়েছিলেন।
উদাহরণ? সেবক কানাইয়ের ওপর খুব চটে গিয়েছেন, একটা ছড়ি নিয়ে তার পিছন পিছন ঘুরে ক্লান্ত হয়ে বসে পড়লেন। পরক্ষণেই ক্রোধের ভাব একেবারে চলে গেল। আর একবার বৃষ্টির সময় ব্রহ্মচারীরা বৃষ্টির পরিভ্রুত জল ধরছিল। কি একটা কারণে স্বামীজি দু’জন ব্রহ্মচারীকে খুব বকছিলেন। তাই দেখে তরুণ অচলানন্দ কঁপতে লাগলেন। তাঁর হাত থেকে বৃষ্টিজলের বোতলটি পড়ে গেল। মুহূর্তে স্বামীজির রাগ চলে গেল। তিনি বললেন, “বাবা, তুই নার্ভাস হয়ে পড়েছিস। যা, আমার ঘরে একটা ওষুধ আছে, খেয়ে শুয়ে পড়গে যা।” তাঁর প্রিয় স্বামী তুরীয়ানন্দকে একবার একটা চিঠি পোস্ট করতে দিলেন। হরি মহারাজ ঠিকানাটা দেখছেন। দেখে বললেন, “হরি ভাই, তোমাকে চিঠিটা ডাকে ফেলতে দিয়েছি, ঠিকানা পড়তে তো বলিনি। অন্যের চিঠির ঠিকানা তুমি কেন পড়, এ কাজ তোমার ঠিক নয়। ব্যাপারটা লুকনো কিছু নয়, স্বয়ং হরি মহারাজই বলে গিয়েছে।
কিন্তু মানুষের জন্যে স্বামীজির স্নেহের শেষ নেই। স্বামী অচলানন্দ বললেন, একটি বালক ফলের রস করতে গিয়ে একবার একটা সৌখিন কাঁচের গ্লাস ভেঙে ফেললো। সবাই তাকে বকাবকি করছে শুনে স্বামীজি বললেন, “ঠাকুরের কাছে আমরা গিয়েছিলাম, তিনি কত ভালবাসা দিয়ে আমাদের আপন করে নিয়েছিলেন, এরা ঘরবাড়ি ছেড়ে আমাদের এখানে এসেছে। এদের এরকম ভীষণ বকুনি দিলে চলবে কেন? এরা থাকতে পারবে কেন? গেলাস তো ঐভাবেই যাবে, গেলাসের তো আর কলেরা হবে না, থাইসিসও হবে না।”
শতাব্দীর ব্যবধানেও বেলুড় মঠের প্রাণপুরুষের শেষ দিকের সব ঘটনা আজও ধৈর্য সহকারে সংগৃহীত বা লিপিবদ্ধ হয়নি। অথচ স্বামীজির অন্ত্যলীলার বিস্তৃত ও বিশ্বাসযোগ্য ছবি আঁকতে গেলে এইসব ঘটনাগুলির গুরুত্ব অসীম। দু’একটি কাহিনি নিশ্চিন্তে পরিবেশন করাটা বোধ হয় অযৌক্তিক হবে না। স্বামী শুদ্ধানন্দ (মঠ মিশনের সভাপতি) ১৮৯৭ সালে আলমবাজার মঠে যোগ দিয়ে স্বামীজির কাছে মন্ত্রদীক্ষা গ্রহণ করেন।
স্বামীজির ইংরেজি গ্রন্থাবলীর এক বৃহদংশের সার্থক বঙ্গানুবাদক তিনি। তিনি বলছেন, একদিন মঠের বারান্দায় স্বামীজি বেদান্ত পড়াতে বসেছে, এমন সময় তাঁর গুরুভ্রাতা এসে সন্ন্যাসী-ব্রহ্মচারিগণকে বললেন, চল হে চল, আরতি করতে হবে চল। স্বামীজি বিরক্ত হয়ে বললেন, “এই যে বেদান্ত পড়া হচ্ছিল, এটা কি ঠাকুরের পূজা নয়? কেবল একখানা ছবির সামনে সলতে-পোড়া নাড়লে আর ঝদ পিটলেই মনে করছিস বুঝি ভগবানের যথার্থ আরাধনা হয়। তোরা অতি ক্ষুদ্রবুদ্ধি।”
এইরকম অস্বস্তিকর পরিবেশে বেদান্ত পাঠভঙ্গ ও আরতি হলো। আরতির পর কিন্তু স্বামীজির গুরুভ্রাতাকে দেখা গেল না। স্বামীজি ততক্ষণে ব্যাকুল হয়ে বলছেন “কোথায় গেল, সেকি আমার গালাগাল খেয়ে গঙ্গায় ঝাঁপ দিতে গেল?” বহুক্ষণ পরে ছাদ থেকে ধরে আনা হলো গুরুভাইকে, স্বামীজির ভাব ততক্ষণে বদলে গিয়েছে। তিনি কত আদর, কত যত্ন করতে লাগলেন।