আর একদিন ভারি চটে গিয়ে স্বামীজি বলছেন, “একাই যাত্রা করতে হলোবাজানো, গাওয়া সব একাই করতে হলো, কেউ কিছুই করলে না।” আমাদের তো গালাগালি দিচ্ছেনই–ঠাকুরের উপরেও ভারি অভিমান হয়েছে। তাকেও গাল দিচ্ছেন, “পাগলা বামুন, মুখর হাতে পড়ে জীবনটা বৃথা গেল।”
গুরুভাইরা তার সম্বন্ধে আরও সব আশ্চর্য কথা লিখে গিয়েছেন। সুস্থ অবস্থায় স্বামীজির শান্তভাবের। স্বামীজি তখন আমেরিকায়, আত্মার অজত্ব ও অমরত্ব উপদেশ দিতেন, আমি আত্মা, আমার জন্মও নেই মৃত্যুও নেই। আমার আবার ভয় কাকে?
কতকগুলো কাউ বয়’তাকে পরীক্ষা করবার জন্য তাদের মধ্যে বক্তৃতা দিতে নিমন্ত্রণ করে। স্বামীজি যখন বক্তৃতা দিচ্ছেন, সেই সময় তারা ডেডশটস (বেপরোয়া গুলি) তার কানের, মাথার নিকট দিয়ে চালাতে আরম্ভ করল, স্বামীজি কিন্তু নির্ভীক, অবিচলিত, তার বক্তৃতারও বিরাম নেই, তখন সেই কাউবয়রা আশ্চর্য হয়ে তার কাছে দৌড়ে গেল, আর বলতে লাগলো, ইনিই আমাদের হিরো।…
“স্বামীজি শেষদিন পর্যন্ত খেটে গিয়েছেন। দেখেছি, শেষ অসুখের সময় বুকে বালিশ দিয়ে হাঁপাচ্ছেন; কিন্তু এদিকে গর্জাচ্ছেন। বলছে, “ওঠো, জাগো, কি করছো?”
কিন্তু পাল্লা দিয়ে বেলুড়ে চলেছে বড় বড় মানুষদের মান অভিমানের পালা। স্বামীজির চোখে তখন ঘুম আসে না। নিদ্রাহীনতা রোগে রাতের পর রাত কেটে যায়। স্বামীজির প্রিয়তম শিষ্যদের মধ্যে স্বামী সদানন্দ, গুপ্ত মহারাজ নামে সবার কাছে পরিচিত। একসময় হাতরাস স্টেশনে রেলের কর্মী ছিলেন, কী করে এক অপরাহে তিনি অনাহারে থাকা রমতি সন্ন্যাসীকে নিজের কোয়ার্টারে ডেকে এনে সেবা করেছিলেন এবং যথা সময়ে বৈরাগ্যের দীক্ষা নিয়েছিলেন তা বিবেকানন্দপ্রেমীদের স্মরণে আছে। স্বামীজির মহানির্বাণের কাছাকাছি সময়ে গুপ্ত মহারাজ ছিলেন বেলুড়মঠে। তখন তার শরীর ভাঙনের পথে। একদিন কি কারণে স্বামীজি চটে লাল হয়ে নিজের ঘরে বসে আছেন। মেজাজ অত্যন্ত গরম। কার সাধ্যি সামনে এগোয়। খানা তৈরি করে কোমরে বাবুর্চির ভোয়ালে জড়িয়ে ঘরে খাবার নিয়ে সাধাসাধি, মহারাজ নরম হোন। গুস্সা ছোড় দিজিয়ে। টেমপারেচার তবু নামে না।–মেহেরবানি করুন, সব কুছ কসুর মাফ কিজিয়ে। যাঃ শালা, দূর হ, খাব না। সদানন্দ তখন দাঁত দেখালেন, তুমভি মিলিটারী, হামভী মিলিটারী, রেগে হাত নেড়ে মুখের উপর বলে তরতর করে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে এলাম। যাঃ শালা। ভুখা রহো, হামারা ক্যা খারাপ! কিন্তু সবাই জানতো ওটা মুখের কথা, স্বামীজি অনাহারে বসে থাকবেন আর তার কাছের মানুষরা আহার করবেন এমন ঘটনা কোনোদিন ঘটেনি রামকৃষ্ণ সঙ্ঘে।
মঠে স্বামী বিবেকানন্দ নিজেই অনেকবার বলেছেন, যাঁরা তাঁর বিশেষ প্রিয় পাত্র তাদেরই তিনি বেশি বকাবকি করেন। কথাটা অতিরঞ্জিত নয়। কারণ সবচেয়ে তার রাগের সামনে পড়তেন স্বামী ব্রহ্মানন্দ ও স্বামী সারদানন্দ। এই সারদানন্দকেই তিনি বিদেশে নিয়ে গিয়েছিলেন। অনেক দিন পরে দু’জনে দেখা হলো লন্ডনে। দু’জনেরই মধ্যে সীমাহীন ভালবাসা, কিন্তু শুনুন স্বামী সারদানন্দ কী বলছেন প্রত্যক্ষদর্শী মহেন্দ্রনাথকে।
“নরেনের হাপরে পড়ে প্রাণটা আমার গেল। কোথায় বাড়ি ছাড়লাম মাধুকরী করব, নিরিবিলিতে জপ ধ্যান করব। না এক হাপরে ফেলে দিল। না জানি ইংরাজি,না জানি কথাবার্তা কইতে, অথচ তাইশহচ্ছে–লেকচার কর, লেচার কর। আরে বাপু আমার পেটে কিছু আছে? আবার নরেন যা রাগী হয়েছে কোনদিন মেরে বসবে। তা চেষ্টা করব, দাঁড়িয়ে উঠে যা আসবে তাই একবার বলব; যদি হয়তো ভাল, না হয় চো চা মারব। একেবারে দেশে গিয়ে উঠব। সাধুগিরি করব, সে আমার ভাল। কি উপদ্রবেই না পড়েছি। কি ঝকমারির কাজ। এমন জানলে কি এখানে আসতাম? শুধু নরেনের অসুখ শুনেই এলাম।”
সেবার লন্ডনে স্বামীজি তাঁর ভাই মহিম ও সারদানন্দের আচমকা অসুখ-বিসুখ নিয়ে খুব বিব্রত হয়েছিলেন। একে তো পরের দয়ায়, পরের আশ্রয়ে থাকা। সহায় সম্বল প্রায় কিছুই নেই। তার ওপর সারদানন্দ ইংরেজিতে বক্তৃতা দিতে উৎসাহিত হচ্ছেন না। এই সময় আবার সারদানন্দের প্রবল ম্যালেরিয়া জ্বর। সারদানন্দের ধারণা, স্বামীজি যা নির্দেশ দিয়েছেন তা করাবেনই। জ্বরে হাঁসফাঁস করতে করতে তিনি পায়চারি করছেন এবং মহিমকে বললেন, “দেখ মহিম, নরেন তো ছাড়বে না। যেকোন প্রকারেই হোক লেকচার দেওয়াবেই। এবার লেকচার রিহার্সাল শুরু করলেন মহিমের সামনে, অনুরোধ করলেন তুমি কিন্তু হু দিও।”
মহিমেরও তখন জ্বর! চেয়ারে বসে অতিকষ্টে হু দিতে লাগলেন। এরপরে উভয়েই বিছানার ভিতর কম্বল মুড়ে শুয়ে পড়লেন, কিন্তু সারদানন্দ মাথা পর্যন্ত কম্বল ঢেকে লেকচার আওড়াতে লাগলেন। প্রায় পাঁচটার সময় স্বামীজি ঘরে এসে ঢুকে সারদানন্দকে লেকচার আওড়াতে শুনে হেসে ধমক দিয়েছেন, সারদানন্দ চিন্তামুক্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন। পরের দিন সারদানন্দর জ্বর একটু কম, কিন্তু মহিম কাহিল, বেহুশ অবস্থায় একঘণ্টার উপর ছিলেন। বিব্রত বিবেকানন্দ বিদেশে বোধ হয় বাধ্য হয়ে বিশেষ শক্তি প্রয়োগ করলেন। ভাই লিখেছেন, স্বামীজি ঘরে ঢুকে যখন শুনলেন জ্বর নেই তখন বললেন, যা আর জ্বর আসবে না, আমি নীচে বসে উইলফোর্স দিচ্ছিলাম। সারদানন্দও ভালবাসায় মুগ্ধ, স্বামীজিকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললেন, “আমার মনটা ভাল করে দাও, এটাকে উপরে তুলে দাও।”