বহুজনের হিত, বহুজনের সুখের স্বপ্ন বুকে রেখেও কত সংগঠন শেষ পর্যন্ত অস্তিত্ব রক্ষায় অসমর্থ হয়েছে। সংগঠক বিবেকানন্দের মনের মধ্যে বহু চিন্তা একই সঙ্গে রূপ পরিগ্রহ করেছিল। একবার তিনি বলেছিলেন, “আমি তো পত্তন মাত্র করে দিচ্ছি–এরপরও আরও কত কী হবে। আমি কতক করে যাব, আর তোদের মধ্যে নানা আইডিয়া দিয়ে যাব, তোরা পরে সেসব কাজে পরিণত করবি। বড় বড় নীতি কেবল শুনলে কী হবে। সেগুলিকে কর্মক্ষেত্রে দাঁড় করাতে–প্রতিনিয়ত কাজে লাগাতে হবে।”
প্র্যাকটিক্যাল বিবেকানন্দ তার গুরুদেবের নামাঙ্কিত সংঘ পরিচালনার জন্য অনেক প্র্যাকটিক্যাল নিয়মকানুনও সুনিশ্চিত করে গিয়েছেন। অর্থই অনর্থের মূল–অতএব সন্ন্যাসীসকেও পাইপয়সার হিসেব নিষ্ঠার সঙ্গে রাখতে হবে, সেই হিসেব নিয়মিত অডিট করাতে হবে এবং শাকের টাকা মাছে এবং মাছের টাকা শাকে খরচ করা চলবে না। সেইসঙ্গে নিতান্ত সহজভাবে বিবেকানন্দ বলেছেন, “বিদ্যার অভাবে সম্প্রদায় নীচদশাপ্রাপ্ত হয়, অতএব সর্বদা বিদ্যার চর্চা থাকবে। ত্যাগ ও তপস্যার অভাবে বিলাসিতা সম্প্রদায়কে গ্রাস করে, অবএব ত্যাগ ও তপস্যার ভাব সর্বদা উজ্জ্বল রাখতে হবে।”
সংগঠক বিবেকানন্দ যে তার সমকাল থেকে বহুযোজন এগিয়েছিলেন তা বোঝা যায় তার প্রতিষ্ঠিত সংঘের আর একটি নিয়মে–”কোনও দেশেই আধ্যাত্মিক ভাব মাত্রেরই প্রয়োজন। কোনও দেশে ইহজীবনের কিঞ্চিৎ সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের অতীব প্রয়োজন। এই প্রকার যে জাতিতে বা যে ব্যক্তিতে যে অভাব অত্যন্ত প্রবল, তাহা পূর্ণ করিয়া সেই পথ দিয়া তাহাকে লইয়া যাইতে হবে।”
সংগঠক বিবেকানন্দ আরও বলে গেলেন, “এই সংঘই তাঁহার অঙ্গ স্বরূপ এবং এই সংঘেই তিনি সদাবিরাজিত। একীভূত সংঘ যে আদেশ করেন তাহাই প্রভুর আদেশ, সংঘকে যিনি পূজা করেন তিনি প্রভুকে পূজা করেন এবং সংঘকে যিনি অমান্য করেন তিনি প্রভুকে অমান্য করেন।”
একবার এক ম্যানেজমেন্ট বিশেষজ্ঞ আমাকে বলেছিলেন, “এত দুর্যোগের মধ্যেও বিবেকানন্দ প্রতিষ্ঠিত রামকৃষ্ণ মঠমিশন শতাব্দীর বেশি সময় ধরে কীভাবে বেঁচে রইল এবং এমনভাবে বিস্তারিত হল তা অনুসন্ধান করা উচিত। ঠিক মতন খুঁজলে দেখা যাবে, একজন সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী সংগঠকই এ দেশের শ্রেষ্ঠতম ম্যানেজমেন্ট বিশারদ। বুদ্ধ, শংকরাচার্য ও বিবেকানন্দকে না বুঝলে এ দেশে ম্যানেজমেন্ট-চর্চার কোনও মানেই হয় না।”
আমিও একসময়ে সন্ধান করেছি সেই মন্তব্যটির যা একটি বাক্যের মধ্যে বিবেকানন্দের ব্যাপ্তি ও বৈচিত্র্যকে বুঝিয়ে দেবে।
অবশেষে সেই বর্ণনাটি খুঁজে পেয়েছি ১৯৩২ সালের ইংরিজি প্রবুদ্ধ ভারত পত্রিকায়। “ত্যাগে বেপরোয়া, কর্মে অফুরন্ত, প্রেমে সীমাহীন, ইমোশনে উচ্ছল, আক্রমণে নির্দয়, অথচ জ্ঞানে গভীর এবং বহুমুখী, অথচ সরলতায় শিশুর মতন–এই হলেন বিবেকানন্দ।” যিনি এই বাক্যটি রচনা করেছিলেন তাঁকেও আমরা চিনি, তাঁর নাম সুভাষচন্দ্র বসু।
১৪. অস্তাচলের পথে
শরীর-স্বাস্থ্য যখন ভালো ছিল তখন স্বামী বিবেকানন্দর একটা মহৎ গুণ ছিল, তাকে কেউ সহজে রাগাতে পারতো না। হয়ত একটা লোক তার সামনে তার বিরুদ্ধে কথা বলছে কিন্তু নিন্দা করে দিল, নানারকম প্রশ্ন করতে আরম্ভ করল, স্বামীজি কিন্তু রাগা দূরের কথা, মুচকি হেসে তার প্রশ্নের যথাযথ উত্তর দিতেন। এই মন্তব্য স্বয়ং স্বামী অখণ্ডানন্দের, যাকে স্বামীজি রসিকতা করে গ্যাঞ্জেস বলে ডাকতেন।
এই স্বামীজিই গুরুতর অসুস্থ হলে কিন্তু শিশুর মতন হয়ে যেতেন। পরিব্রাজক জীবনে হৃষিকেশে তিনি বেশ অসুস্থ হয়ে পড়েন। একটু সুস্থ হয়ে তিনি খিচুড়ি খেতে চাইলেন। প্রিয় গুরুভাই রাখাল (স্বামী ব্রহ্মানন্দ) খিচুড়ি রাঁধলেন, তিনি জানতেন প্রচণ্ড ঝাল না হলে স্বামীজীর পছন্দ হয় না, কিন্তু রোগের কথা ভেবে শেষ মুহূর্তে তিনি খিচুড়িতে একটু মিছরি দিয়ে দিলেন। ঝালখোর স্বামীজির খিচুড়ি মোটেই ভাল লাগছে না, এমন সময় খিচুড়ির মধ্যে একটা সুতো পেলেন। তখনকার দিনে মিছরিতে দু’ একটা সুতো থাকতো। খিচুড়িতে সুতো কেন? জানতে চাইছেন বিরক্ত স্বামীজি, সকলে বলল, এক ডেলা মিছরি ফেলেছে রাখাল। মহাবিরক্ত স্বামীজি এবার আক্রমণ করলেন গুরুভাইকে। “শালা রাখাল, এ তোর কাজ, তুই খিচুড়িতে মিষ্টি দিয়েছিস। দুঃ শালা। তোর একটা আক্কেল নেই।”
স্বামী বিবেকানন্দের প্রসন্ন মেজাজের অজস্র কাহিনি ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। স্বামী তুরীয়ানন্দ (হরি মহারাজ) ছিলেন প্রিয় গুরুভাই, স্বামীজির দেহাবসানের অল্প দিন পর তার সঙ্গে হরিদ্বারে এক সাধুর দেখা হয়। সাধুটি বলেন, “এত সাধুর সঙ্গে মিশেছি কিন্তু তার মতো সাধু কখনন দেখিনি। হাসতে হাসতে পেটে ব্যথা করে দিত, আর হাসির সঙ্গে এমন কথা বলতেন যে একেবারে বৈরাগ্য যেন আবার জেগে উঠত। অমন ইয়ার সাধু জীবনে কখনো আর দেখিনি”।
বিশ্ববিজয়ের পর ফিরে এসে বেলুড়মঠ প্রতিষ্ঠার পরে সদাপ্রসন্ন এবং প্রাণবন্ত বিবেকানন্দের একটি ছবি এঁকে গিয়েছেন স্বামী তুরীয়ানন্দ। “নরেনের সব কাজ কি চটপট, পাগড়ী বাঁধবে তাও কি চটপট…অন্যলোক এক ঘণ্টায় যে কাজ করছে নরেন দু মিনিটে সে কাজ করে ফেলে এবং এক সঙ্গে পাঁচ ছয়টা কাজ করে। এই মানুষটির রেগে যাওয়া অবস্থার ছবিও এঁকেছেন স্বামী তুরীয়ানন্দ। “একদিন মঠ থেকে রেগে বেরিয়ে গেলেন। বললেন, তোরা সব ছোট লোক, তোদের সঙ্গে থাকতে অসহ্য। তোরা সব অনুষ্ঠান শাস্ত্রমত নিয়ে ঝগড়া করবি। কিন্তু শেষটা করলেন কি? সেই ছোটলোকদেরই সব দিয়ে গেলেন।”