সমকালের নিন্দুকরা কীভাবে বিবেকানন্দনিগ্রহে মেতেছিলেন পাঠক পাঠিকারা তার বিস্তারিত বিবরণ পাবেন নানা গবেষণাগ্রন্থে। মিশনারিদের দেওয়া মিথ্যা বদনামের কথা ভাবতে লজ্জা লাগে। বিবেকানন্দ নাকি দুশ্চরিত্র। সন্ন্যাসীর নিজের লেখা থেকে শুনুন : “কখনও কখনও এমন হয়েছে–আমাকে কোনও বাড়িতে নিমন্ত্রণ করেছে দেখে কেউ আমার সম্বন্ধে মিথ্যা কুৎসা বাড়িওয়ালাকে শুনিয়ে দিয়েছে। তাই শুনে সে দোর বন্ধ করে চলে গিয়েছে, আমি নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে গিয়ে দেখি সব ভো ভো, কেউ নেই।”
প্রবীন প্রতাপ মজুমদার নিজের দেশে ফিরে এসে বলতে লাগলেন, “নরেন, সেই ছোঁড়াটা যে ভ্যাগাবন্ডের মতন পথে পথে ঘুরে বেড়াত, সে এক লম্বা জামা পরে, মাথায় পাগড়ি বেঁধে চিকাগো পার্লামেন্টে ত গিয়ে হাজির।” বিদেশেও প্রতাপ মজুমদার বলতেন, “ছোকরা লেখাপড়া কিছুই জানে না। বোধহয় কোনও বিপদে পড়ে এখানে পালিয়ে এসেছে।”
দেশে ফিরেও বিবেকানন্দের কষ্ট ও অপমানের অবধি ছিল না। সুদূর আমেরিকায় সনাতন ভারতের হৃত গৌরব উদ্ধার করে তিনি যখন কলকাতায় ফিরে এলেন, সেই সময় কয়েকজন ভক্তিমতী বিদেশিনী তার সঙ্গে ছিলেন। মুখে-মুখে সেই সময় তার ডাকনাম ছড়ায় বিবি কা-আনন্দ। সাধে কি আর তিনি এক চিঠিতে দুঃখ করেছেন, “এ দেশ হিংসুক নির্দয় লোকে ভর্তি–যারা আমার কাজ লণ্ডভণ্ড করে দিতে চেষ্টার কসুর করবে না।”
দেশে ফিরে এসে দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে প্রবেশ করতে গিয়ে যে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছিল, তার ইঙ্গিতও রয়েছে বিবেকানন্দের চিঠিতে।
উনিশ শতকে যে নিন্দাপ্রবাহের শুরু হয়েছিল একুশ শতকেও তার সম্পূর্ণ অবসান হয়েছে এমন ভাববেন না। সাধ্য থাকলে নিন্দুকেরা প্রমাণ করে দেন, যে-বিবেকানন্দ মঞ্চে দাঁড়িয়ে শ্রোতাদের মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখতেন তিনি তো অভিনেতা বিবেকানন্দ। তাদের মতের পক্ষে প্রমাণ সংগ্রহের জন্য তারা বিভিন্ন স্মৃতিকথার প্রতিটি লাইন আজও তন্ন তন্ন করে খুঁজে বেড়াচ্ছেন!
শুধু অভিনয়ের অভিযোগ নয়, পাশ্চাত্যের ওপর তার প্রভাবে কতখানি দুধ এবং কতখানি জল তা নিয়ে মাপজোক চলেছে। কয়েকজন স্বার্থপর সায়েব সহজবোধ্য কারণে এই কাজ শুরু করেছিলেন এবং কিছু দেশবাসী সেই দায়িত্ব সানন্দে মাথায় তুলে নিয়েছেন। এঁদের নিবেদন, শিকাগোতে বিবেকানন্দের অভূতপূর্ব সাফল্যের একমাত্র কারণ তার সাদা সিল্কের পাগড়ি! বেনামে লেখা একখানা বইয়ের খোঁজও পাওয়া গিয়েছে, সেখানে বলা হচ্ছে, বিবেকানন্দের সাফল্যের অন্যতম কারণ সরল আমেরিকানদের প্রবল কৌতূহল। অভিনবত্ব দেখলেই মার্কিনরা নাকি ভীষণ আকৃষ্ট হয়, তথাকথিত সন্ন্যাসীর বেশে বিবেকানন্দই নাকি প্রথম ভারতীয়, যিনি আমেরিকায় হাজির হয়েছিলেন।
গরিবের জন্য যিনি সহস্রবার নরকে যেতে প্রস্তুত ছিলেন তাঁকে বড়লোকের মোসাহেব হিসেবে আঁকবার চেষ্টাও হয়েছে। স্বামীজিকে যাঁরা কদর করেছিলেন তাঁদের অনেকেই যে ধনী তা মিশনারিরা বলেছেন। খবর দিয়েছেন, স্বামীজির অনুরাগীদের তালিকায় দেখা যাচ্ছে ডেট্রয়েটের খ্যাতনামা ব্যবসায়ী টমাস পামার এবং বিখ্যাত গুডইয়ার টায়ার কোম্পানির ওয়ালটার ও ফ্রস গুডইয়ার, নিউইয়র্কের ধনপতি ফ্রান্সিস লেগেট। সাহেব পাদ্রিদের, প্রচার : এইসব ধনবানদের হাতে ছিল প্রচুর সময় এবং প্রচুর অর্থ, প্রচলিত ধর্মাচরণে সাময়িকভাবে ক্লান্ত হয়ে এঁরা বিকল্প পথের সন্ধান করছিলেন।
সমস্ত তথ্য তন্নতন্ন করে খুঁজে, হন্যে হয়ে নিন্দাবিদরা যে সিদ্ধান্তে পৌঁছতে চেয়েছেন তা হল, প্রবাসে বিবেকানন্দর বাণীতে কোনও নতুনত্ব ছিল না, যতটুকু সাফল্য তার পিছনে রয়েছে মানুষটির ‘ক্যারিশমা’, বলবার স্টাইল এবং ভাষার ফুলঝুরি!
শক্ত মানুষ ছিলেন বিবেকানন্দ, ছিল দুর্জয় সাহস। প্রতিকূল পরিস্থিতিতে ভয় পেয়ে পালিয়ে যাওয়ার লোক তিনি নন, তবু বারবার অন্যায় আঘাতে তিনি যে নীরবে কষ্ট পেয়েছেন, তার ইঙ্গিত রয়েছে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। একবার বেলুড়ে বিবেকানন্দ বললেন, “ঠাকুরঘরে ঠাকুরের সামনে মার্বেল পাথরটায় জল দিয়ে বেশ করে ভিজিয়ে রেখে আয়, মোটে মুছবি না।” বিবেকানন্দ গিয়ে কপাট বন্ধ করে দিলেন, অনেকক্ষণ পরে বেরিয়ে এসে বললেন, “দেখছিস না, চারদিকে কী হচ্ছে? সব শরীর জ্বলে যাচ্ছে, তাই আত্মারামের কাছে গড়াগড়ি দিচ্ছিলাম, ঠাণ্ডা হবো, সব শরীর জুড়াবো বলে।”
মৃত্যু এসে সাধারণ মানুষকে সব যন্ত্রণা থেকে চিরমুক্তি দিয়ে থাকে। কিন্তু যাঁরা মৃত্যুঞ্জয়ী, যাঁদের প্রকৃত বেঁচে থাকা শুরু হয় তিরোধানের মুহূর্ত থেকে, তারা আক্রমণের হাত থেকে কখনও মুক্তি পান না। তাদের কপালে যেমন অসংখ্য অনুরাগীর ভালবাসা ও ভক্তি জোটে, তেমনই জোটে অবিরাম, অপ্রত্যাশিত এবং অন্যায্য নিন্দা। যাঁরা শত্রু, যাঁদের তিনি জীবিত অবস্থায় আক্রমণ করতে চেয়েছেন, তাঁরা আক্রমণ করলে বিস্ময়ের বা বেদনার কিছু থাকে না, কিন্তু যাদের জন্য আত্মত্যাগ, যাদের জন্য নিজেকে তিলেতিলে বিসর্জন দেওয়া, তারা যখন অকারণে আঘাত করে তখন অবশ্যই জানতে ইচ্ছে করে, কেন এমন হয়? কেন আমরা বারে বারে নিজেকে ক্ষতবিক্ষত করি?
বিবেকানন্দের ছোট ভাই ভূপেন্দ্রনাথ তাঁর বইয়ের ফুটনোটে একজন বিদগ্ধ বিখ্যাত বাঙালির উল্লেখ করেছেন, যিনি বিবেকানন্দ স্মরণসভায় আসতে রাজি তো হননি, বরং বলেছে হিন্দু রাজত্ব হলে বিবেকানন্দের প্রাণদণ্ড হতো।