কত রকমের সেই আঘাত! কখনও যে, ইস্কুলে তিনি পড়ান সেখানকার উচ্চশ্রেণীর ছাত্ররা প্রধান শিক্ষক নরেন্দ্রনাথ দত্তের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ করছে তিনি পড়াতে পারছেন না, সেই অভিযোগের ভিত্তিতে বাংলার আর এক মহাপুরুষ নির্দেশ দিচ্ছেন, নরেনকে আর পড়াতে না আসতে। কখনও বলা হচ্ছে, বখাটে ছোঁড়াটা গুরুজনদের তাচ্ছিল্য করে মনের সুখে তামাক খাচ্ছে, এবং নাকে নস্যি গুজছে। কখনও বলা হচ্ছে–চাকরি না পাওয়ায় বৈরাগ্য! স্বভাবসন্ন্যাসী তিনি অবশ্যই নন, সর্ব অর্থে অভাবসন্ন্যাসী। কখনও বিদেশের মাটিতে স্বদেশের মানুষ ঘরের ছেলেকে সাহায্য না করে কুৎসা প্রচার করছে বাউণ্ডুলে ভেঁপো ছোকরা, সে আবার ইংরেজি শিখল কবে?
খ্যাতির মধ্যগগনেও আপনজনদের হাতে বিবেকানন্দ-নিগ্রহ শেষ হয়নি, হিসেব চাওয়া হয়েছে, ক’বার শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণের নাম উচ্চারণ করেছ মার্কিন মুলুকে? প্রশ্ন করা হয়েছে, নিষিদ্ধ পানীয়, নিষিদ্ধ মাংস কি ভক্ষণ করেছ? বিস্মিত বিশ্ব সাষ্টাঙ্গে প্রণত হলেও, পেঁয়োযোগীর অগ্নিপরীক্ষা শেষ হতে চায় না। জন্মভূমি কলকাতায় যাঁরা বিবেকানন্দ অভিনন্দনসভার আয়োজন করেন তারাই লজ্জার মাথা খেয়ে খরচের বিলটা তুলে দিচ্ছেন বিশ্বজয়ীর হাতে। এই সেই দেশ, যেখানে তার মঠের বাড়ির ট্যাক্সো তিনগুণ বাড়িয়ে দেওয়া হয় এবং মৃত্যুর পরেও পুরসভা গড়িমসি করে বেলুড় মঠের গঙ্গাতীরে দাহকার্য সম্পন্ন করার অনুমতি দিতে।
মৃত্যুর পরেও বেঁচে থাকার জন্য যাদের জন্ম, তাদের সব যন্ত্রণা ও লাঞ্ছনা দেহাবসানের সঙ্গে-সঙ্গে শেষ হয়ে যায় না, তাই সন্ধ্যায় শেষনিশ্বাস ত্যাগ করলেও পরের দিন মহানগরীর সংবাদপত্রে স্বামী বিবেকানন্দের আকস্মিক অকালপ্রয়াণ সম্পর্কে কোনও খবর থাকে না, বিশ্ববিশ্রুত সন্তানের স্মরণসভার আয়োজন করতেও লম্বা সময় লেগে যায় এবং স্মৃতিসভায় প্রতিশ্রুতি-দেওয়া সামান্য আর্থিক দানের বড় অংশ শেষ পর্যন্ত সংগৃহীত হয় না এবং আরও কত কী!
তবু কী আশ্চর্য! নিবিড় ঘন অন্ধকারে আকাশের বিদ্যুৎ ঝলকের মতন মহামানব বিবেকানন্দের বাণী আজও পৌঁছে যায় হতোদম মানুষের হৃদয়ে। নতুন করে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে তার অনেক বক্তব্যকে যা তার জীবিতকালে পরিপূর্ণ বোঝা যায়নি। যাঁরা খোঁজ করেন, তারা বুঝে নিয়েছেন, বিবেকানন্দকে ঠিকমতন বুঝতে আমাদের আরও এক হাজার বছর লেগে যাবে। হাজার বছরের হিসেবে হয়তো শেষ পর্যন্ত একটা আন্দাজ পাওয়া যাবে একজন বিবেকানন্দ এক জীবনে মানুষকে কী দিয়ে গেলেন?
কিন্তু একই সঙ্গে চলেছে উল্টোদিকের প্রবাহ! সংখ্যায় নগণ্য হলেও কিছু কিছু সন্দেহবাদী স্বদেশবাসী নিজের দেশে বসে অথবা প্রবাসের দূরত্ব বজায় রেখে দুর্নামের ওভারটাইম খেটে চলেছেন, স্বভাবসন্ন্যাসীটি যে আসলে অভাবসন্ন্যাসী তা প্রমাণ করার জন্য। চোখে চশমা লাগিয়ে, অনেক মাথা খাঁটিয়ে, পুরনো খবরের কাগজ ঘেঁটে তারা প্রমাণ করবেনই, দুনিয়ার লোকরা একশ’ বছর ধরে মস্ত ভুল করে চলেছেন এমনভাবে বিবেকানন্দ বন্দনা চালু রেখে। এঁদের চেষ্টা, লোকের কানে কানে বলা, বিবেকানন্দ আবার মহাজ্ঞানী হলেন কবে? নরেন্দ্রনাথ ‘ইন্টেলিজেন্ট’ ছিলেন, কিন্তু কৃতী ছাত্র তো ছিলেন না, এফ এ এবং বি এ পরীক্ষায় সেকেন্ড ডিভিশন নম্বর কেন? কথামৃত মন দিয়ে পড়লেই নাকি নজর এড়ায় না যে, ঠাকুর শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ নরেনকে বড্ড বেশি প্রশ্রয় দিতেন, গান শুনে গদগদ হয়ে মন্দিরের ছোট ভাজ্যি বলে বসলেন, নরেন ধ্যানসিদ্ধ, নিত্যসিদ্ধ এবং ঈশ্বরকোটী। আরও একটি নিষ্ঠুর ইঙ্গিত, ঠাকুরের দেহাবসানের পর, বরাহনগরের যে কৃচ্ছসাধনা তার মূলে তার পারিবারিক অশান্তি এবং অর্থাভাব!
এতেও মন ভরছে না একাল ও সেকালের নিন্দুকদের। কেন বিবেকানন্দ বললেন, ভাল রাঁধতে না জানলে ভাল সাধু হওয়া যায় না? বিদেশে পাড়ি দেওয়ার আগে স্বদেশে তার পরিব্রাজক জীবনটা এক ধরনের ‘হিচ হাইকিং’ ছাড়া কিছু নয়। এঁদের নিবেদন, উত্তর ও দক্ষিণ ভারতের সম্ভ্রান্ত লোকরা ফার্স্ট ক্লাসের টিকিট কেটে দিতেন, সুতরাং কষ্ট কোথায়? কেন তিনি এত লঙ্কা খেতেন? উত্তর কলকাতার এই সুখী গ্র্যাজুয়েট ভদ্রলোকটি তো গরমের আতঙ্কে রাজপুতানায় আসতেই চাননি! ভক্তরা তাদের বইতে যতই তাকে মহাযোগী অ্যাখ্যা দিক, আসলে সংসারের আর্থিক হাঙ্গামা থেকে মুক্তি পাবার জন্যই সন্ন্যাসীর নিশ্চিন্ত জীবনযাপন!
শুনুন আরও একটা অভিযোগ! স্বামীজি বিদেশে বললেন, ইংল্যান্ডের মাতালের সংখ্যার তুলনায় ভারতে মাতালের সংখ্যা অনেক কম! ওখানে চারশ’ জনে একজন, আর স্বদেশে দশ লাখে একজন! সঙ্গে সঙ্গে নিন্দুকদের পাল্টা আঘাত, বিবেকানন্দের সমকালীন কলকাতায় সব ‘ভদ্রলোকই তো মাতাল! ভারতীয়ত্বের যেসব গুণকীর্তন বিবেকানন্দ বিদেশে করেছেন সেসবই বাজে! বিবেকানন্দ কেন সমাজতন্ত্রের গুণগান করেছেন? এ নিয়ে বেজায় গোঁসা কিছু পণ্ডিতের! কোথাকার কোন রাশিয়ান বিবেকানন্দর এই সোশ্যালিজমকে আবছা এবং অস্পষ্ট বলায় তাঁদের বেজায় আনন্দ।
এহেন বিবেকানন্দ কী করে বিশ্ব বিজয় করলেন তা নিয়ে সন্দেহের অভাব নেই। প্রবাসে তিনি বক্তব্যের জন্য বিজয়ী হননি, সরলমনা বিদেশিনীদের মনোহরণ করেছিলেন তার শারীরিক সৌন্দর্য এবং বাচনভঙ্গি দিয়ে। তার শিকাগো বক্তৃতায় নাকি আধ্যাত্মিক নতুনত্ব একফোঁটাও ছিল না, বরং ভারত সম্বন্ধে অনেক অবান্তর এবং অবাস্তব দাবি ছিল, সেই জন্যেই শিকাগোতে হাততালি পড়েছিল, তবে একই সভায় আরও বেশি হাততালি পেয়েছিলেন কলকাতার আর এক বক্তা প্রতাপ মজুমদার! অর্থাৎ বক্তব্যের জন্য নয়, বলার স্টাইলের জন্যই শিকাগোয় শিহরন! সেইসময় বারবার এই ধরনের নানা অভিযোগে জর্জরিত হয়েছিলেন বিবেকানন্দ। নিগৃহীত হয়েছিলেন কয়েকজন স্বার্থান্ধ যাজকের হাতেও, এখন নিগৃহীত হচ্ছেন নিজের দেশের নিন্দুকদের হাতে। মৃত্যুর একশ বছর পরেও এঁদের দুঃখের শেষ হল না, কেন একজন সেকেন্ড ডিভিশন গ্র্যাজুয়েটকে নীলোৎপলনয়ন’ বাকপতি’ইত্যাদি বলা হয়েছিল?