নিজের ঘরে সন্ধ্যা সাতটায় জপধ্যান শুরু করলেন স্বামীজি, এবং এক তরুণ সেবক বাঙাল ব্রজেন্দ্রকে বললেন, আমাকে দু’ছড়া মালা দে, যা বাইরে গিয়ে জপধ্যান কর। না ডাকলে আসবি না।
সন্ধ্যা ৭.৪৫: ব্রজেন্দ্রকে স্বামীজি বললেন, গরম বোধ হচ্ছে, জানলা খুলে দাও। মেঝেতে শুয়ে পড়লেন বিবেকানন্দ, হাতে জপমালা। একটু পরে বললেন, আর বাতাস করতে হবে না। একটু পা টিপে দে।
রাত ন’টা: চিত হয়ে শুয়ে থাকা স্বামীজি বাঁ পাশে ফিরলেন। কয়েক সেকেন্ড তার ডান হাত একটু কাপল। স্বামীজির কপালে ঘামের ফোঁটা। এবার শিশুর মতো কান্না।
রাত ৯.২ থেকে ৯.১৫: গভীর দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন। মিনিট দুই স্থির, আবার গভীর দীর্ঘশ্বাস। মাথা নড়ে উঠল, মাথা বালিশ থেকে পড়ে গেল। চোখ স্থির, মুখে অপূর্ব জ্যোতি ও হাসি।
এবার শোনা যাক কানাই মহারাজের দুঃখের কথা। “ঐদিনটিতে আমার শরীর একটু অসুস্থ বোধ করায় আমি তার সেবা না করে ব্রজেন বলে একটি নতুন ব্রহ্মচারীকে তাঁর সেবার ভার দিয়েছিলুম। ব্রজেন এসে আমাকে বলল যে শীঘ্র আসুন, দেখুন স্বামীজির কী অবস্থা হয়েছে। তখন দেখলাম স্বামীজি তার ক্যাম্পখাটটিতে দক্ষিণ পাশ ফিরে শুয়ে আছেন এবং তার ডান নাক দিয়ে রক্ত গড়াচ্ছে। তাড়াতাড়ি গিয়ে উপস্থিত সকল মহারাজকে ডেকে আনলাম।”
তখন সময় ৯.৩০। স্বামী বোধানন্দ নাড়ি ধরে কিছুক্ষণ দেখে, দাঁড়িয়ে উঠে কেঁদে ফেললেন। একজন বললেন, যাও মহেন্দ্র ডাক্তারকে ডেকে আনো। কদিন তিনিই চিকিৎসা করছিলেন। ডাক্তার মজুমদার থাকতেন নদীর ওপারে বরাহনগরে। স্বামী প্রেমানন্দ ও স্বামী নিশ্চয়ানন্দ সমাধি ভাঙানোর জন্য কানে রামকৃষ্ণ নাম শোনাতে লাগলেন।
শেষের সময়ে স্বামী ব্রহ্মানন্দ বা স্বামী সারদানন্দ কেউ মঠে উপস্থিত ছিলেন না। স্বামী ব্রহ্মানন্দ ছিলেন বলরাম মন্দিরে এবং স্বামী সারদানন্দ বাগবাজার উদ্বোধন অফিসে। কৃত্রিম উপায়ে হার্ট সচল করার চেষ্টা চলল। ডাক্তার মজুমদার ও তারা দু’জন রাত সাড়ে দশটায় প্রায় একসঙ্গে উপস্থিত হলেন। রাজা মহারাজ এসেই দৌড়ে গিয়ে দেহের উপর হুমড়ি খেয়ে হাউ হাউ করে কাঁদতে লাগলেন।
রাত ১২টা : ডাক্তার মজুমদার জানালেন, স্বামীজি আর ইহলোকে নেই। হঠাৎ হার্ট বন্ধ হওয়াই স্বামীজির দেহাবসানের কারণ। পরের দিন সকালে ডাক্তার বিপিন ঘোষ বললেন, সন্ন্যাস রোগে দেহত্যাগ হয়েছে। কেউ কেউ বললেন, মাথার ভিতর কোনও শিরা ছিঁড়ে গিয়েছে।
স্বামীজির ডেথ সার্টিফিকেট খুঁজে পাওয়া যায়নি। সেখানে কী অসুখের উল্লেখ ছিল তা আর জানবার উপায় নেই। উদ্বোধন পত্রিকায় স্বামীজির দেহাবসানের যে সংবাদ প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল সেখানে বলা হয়েছে, তিনমাস ধরে গুরুতর অ্যালবুমেনিউরিয়া রোগে ভুগছিলেন।
স্বামীজির পত্রাবলী ঘাঁটতে-ঘাঁটতে আমরা শুধু বুঝি, মৃত্যুকে সাদর আমন্ত্রণ জানানোর জন্য তিনি বেশ কিছুদিন ধরেই প্রস্তুত হচ্ছিলেন। মার্কিন অনুরাগী মিস্টার ফক্সকে তিনি লিখেছিলেন, “আমার শরীর দ্রুত ভেঙে যাচ্ছে। মহিমকে মাকে এবং সংসারকে দেখার ভার নেবার জন্য তৈরি হতে হবে। আমি যে কোনও সময় চলে যেতে পারি।” এই চিঠি লেখার কারণ ভাই মহেন্দ্রনাথ তখনও উধাও। ইউরোপ থেকে পায়ে হেঁটে দেশে ফিরতে ফিরতে কয়েক বছর তিনি মা ভাই দাদা কাউকে চিঠি লেখেননি। সেজন্য স্বামীজির দুঃখের অন্ত ছিল না। প্যারিস থেকে প্রিয় হরিভাইকে (স্বামী তুরীয়ানন্দ) দুঃখী বিবেকানন্দ লিখেছিলেন, “আমার কাজ আমি করে দিয়েছি বস্। গুরু মহারাজের কাছে ঋণী ছিলাম–প্রাণ বার করে আমি শোধ দিয়েছি।”
১৩. অবিশ্বাস্য সংগঠক বিবেকানন্দ
তিরোধানের শতাব্দী অতিক্রম করেও স্বামীজি প্রবলভাবে বেঁচে রয়েছেন। অকালমৃত্যু তার জয়রথের গতি শ্লথ তো করতেই পারেনি, বরং নতুন শতকে যাঁদের হৃদয়সিংহাসনে তিনি রাজাধিরাজ রূপে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছেন তাদের সংখ্যা স্বদেশ এবং বিদেশে ক্রমেই বেড়ে চলেছে।
বলা অত্যুক্তি হবে না, একালের ইতিহাসে এমন বিজয়কাহিনি বিরল। কী এমন ছিল বিবেকানন্দের মধ্যে? কী এমন তিনি দিয়ে গেলেন মানুষকে, যে এমন অঘটন ঘটা সম্ভব হল? যাঁরা নতমস্তকে অবিশ্বাস্য বিবেকানন্দকে হৃদয়ে গ্রহণ করেছেন, তারা নিজেরাও এ প্রশ্নের পূর্ণ উত্তর দিতে অক্ষম। তবে তারা বলেন স্বামীজির জীবনই যেমন তাঁর বাণী, তেমন তার বাণীও হয়ে উঠতে পারে নতুন এক ভারতবর্ষের জীবন। নিষ্ঠুর সময় আজও অবিশ্বাস্য বিবেকানন্দকে সীমিত করতে পারেনি, বরং যতই সময় অতিবাহিত হচ্ছে ততই তাঁর উপদেশ এবং আহ্বান আরও অর্থবহ এবং সময়োচিত হয়ে উঠছে। নতমস্তকে স্বীকার করে নেওয়া যাক, এ দেশের ইতিহাসে এমন ঘটনা ইদানীং আর ঘটেনি।
ইদানীং যারা বড় হয়ে উঠেছেন তারা যেন মনে না করে বসেন–স্বামী বিবেকানন্দ এসেছিলেন, দেখেছিলেন এবং মানুষকে জয় করেছিলেন। এই সেদিন কে যেন বলল, তার আবির্ভাব তো আকাশে, সেখান থেকেই বিদ্যুৎ ও বজ্রসম তিনি নেমে এলেন মাটির পৃথিবীতে, সুতরাং কে তাকে জীবনের যন্ত্রণা সম্পর্কে প্রশ্ন করবে? ব্যাপারটা অলৌকিক হলে মন্দ হত না। কিন্তু স্মরণে রাখা প্রয়োজন নিষ্ঠুর সমকাল সন্ন্যাসী বিবেকানন্দকে অত সহজে ছেড়ে দেয়নি। আঘাতে, অপমানে, সন্দেহে এবং অবিশ্বাসে তিনি বারে বারে জর্জরিত হয়েছেন। নীলকণ্ঠের মতো সেই বিষ তিনি ধারণ করলেও, তার মনের কোথাও তা অস্বস্তিকর দাগ রেখে যায়নি, এ কথা জোর করে বলা চলে না। তার ব্যক্তিগত চিঠির কোথাও কোথাও সেই আহত এবং অপমানিত বিবেকানন্দকে আজও কয়েক মুহূর্তের জন্য আমরা দেখতে পাই।